কুয়াশা - ১ | পর্ব - ৮
রাত দেড়টা। দুপুরে ঘুমিয়েছে তাই কিছুতেই শহীদের চোখে ঘুম আসছে না। ইংরেজি বইটা শেষ করে সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিলো। বিছানায় ঢুকে মশারীর চারিধারটা ভালো করে গুজে নিয়ে সে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলো।
হঠাৎ তার অত্যন্ত কান সজাগ হয়ে উঠলো। সরোদের আওয়াজ! এতো রাতে তো কোনও রেডিও- ষ্টেশন ধরবার কথা নয়। কোনও সঙ্গীত সম্মেলনও হতে পারে না। তার চোখ এড়িয়ে সম্মেলন হবার জো নেই। আর এতো রাতে সঙ্গীত সম্মেলন ছাড়া আর কোনও কারণেই রেডিও খুলবে না কেউ। হাত ঘড়িটার দিকে তাকায় শহীদ -রেডিয়াম দেয়া ঘড়ি-দেড়টা বাজে।
ধীরে ধীরে আলাপ হচ্ছে। বড় ভালো বাজাচ্ছে তো! কি বোল্ড টোকা! কি মিষ্টি। এক আলী আকবর খান ছাড়া আর কারও হাত দিয়ে এ টোকা বেরোবার কথা নয়। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এলো শহীদ। জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। উঃ, অদ্ভুত সুন্দর বাগেশ্রী বাজাচ্ছে। এক টান দিয়ে দামী আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘরের দরজা ভিড়িয়ে বেরিয়ে এলো সে হোটেল থেকে। দেখতেই হবে এই মফঃস্বল শহরে কে এতোবড় শিল্পী।
আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল শহীদ। নদীর পারের দোতলাটা থেকে শব্দ আসছে। সে গিয়ে দাঁড়ালো বাড়িটার কাছে। উচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটা। লোহার একটা গেট আছে। সটান গেট খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লো শহীদ। দোতলায় বসে কে যেন বাজাচ্ছে। নিচে বারান্দায় উঠবার সিঁড়ির উপর বসে পড়লো শহীদ।
বেজে চলেছে সরোদ। কি অদ্ভুত মিষ্টি! স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেল শহীদ। বুঁদ হয়ে বসে রইলো সিঁড়ির উপর। তার মনে হলো বাগেশ্রী যেন হেমন্ত কালের রাগ। সেই যে তার কিশোর বয়সে বিকেল বেলা সে আর কামাল পুরানা পল্টনের এক বাসায় ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতো। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় সরু একটা পায়ে-হাঁটা পথ দিয়ে বাড়ি ফিরতো তারা। আশে পাশে ছোটখাটো ঝোপ, মাঝে মাঝে ঘন। মস্ত বড় বড় শাল গাছগুলোর তলায় আঁধার হয়ে এসেছে। পথের একধারে ছিলো একটা পুকুর। অজস্র লাল শাপলা ফুটে থাকতো তাতে। কুয়াশা পড়তো। ডোম-পাড়া থেকে ঘুটে পোড়ানোর গন্ধ আসতো। শিউলীর গভীর ভারি গন্ধটা নেশা ধরাতো। একটা দুটো করে বাতি জ্বলে উঠতো। সেই পুরোনো স্মৃতি জেগে উঠলো শহীদের মনে। তাদের গায়ে থাকতো হাতে বোনা সোয়েটার-প্রথম বের করা হয়েছে টাঙ্ক থেকে, তাতে ন্যাপথালিনের গন্ধ জড়ানো। শহীদের মনে হলো এখনও যেন সেই গন্ধ পাচ্ছে। সেই কিশোর বয়স। পৃথিবীটা কতো ছোটো তার কাছে তখন। মনটা তখন ঠিক কচি একটা গোলাপের কুঁড়ির মতো। বড় ভালো লাগে শহীদের। সাথে সাথে কষ্টও লাগে। ছোটকালের শহীদটাকে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে তার।
তন্ময় হয়ে শোনে শহীদ। আলাপ ছেড়ে গৎ ধরলো বাদক। বড় সুন্দর অস্থায়ী অন্তরা। ষ্টাইল আছে, গায়কী আছে। খানদানী ঢং আছে।
কিন্তু তবলা নেই। কিছুক্ষণ বাজিয়ে বোধকরি বিরক্ত হয়েই থেমে গেল বাদক।
শহীদও বিরক্ত হয়েছে। ফিরে যাচ্ছে সে। গেটের কাছে যেই এসেছে এমন সময় উপর থেকে গভীর গলায় আওয়াজ এলো, কে?
চমকে উঠলে শহীদ। উঃ, কী ভারি গলা?
আমি অনাথ চক্রবর্তী, রায়পুরার জমিদার। আমি এই পাশের হোটেলে উঠেছি। আপনার বাজনা শুনে এসেছিলাম ভালো করে শুনতে। অনধিকার প্রবেশের জন্যে ক্ষমা চাইছি।
আপনি উপরে আসুন আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।
বাইরের দিকে একটা বাতি জ্বলে উঠলো। শহীদ দাঁড়িয়ে রইলো। একবার ভাবলো চলে যাবে কিনা কিন্তু আবার কৌতুহল হলো, দেখেই যাই লোকটাকে। এতোক্ষণে তার একটু শীত শীত বোধ হচ্ছে। রাত বোধহয় তিনটের কম না। দরজা খুলে যে লোকটা বেরিয়ে এলো, তাকে দেখেই শহীদ চিনতে পারলো। একেই সে দেখেছে আজ বিকেলে নদীর ধারে পাথরের উপর বসে থাকতে। লোকটা অত্যন্ত ভদ্র ভাবে বললো, আপনি আমার সাথে উপরে আসুন। শহীদ তার পিছন পিছন দোতলায় উঠে এলো।
শহীদকে একটা চেয়ারে বসতে অনুরোধ করে সে একটা ইলেকট্রিক স্টোভে এক কেটলি জল চড়িয়ে দিলো। তারপর ভালো করে শহীদের দিকে চেয়ে বললো, বাইরে শীতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে আপনার? আমাকে ডাকলেই পারতেন, মিছিমিছি এতো কষ্ট পেলেন অনাথ বাবু।
এখন মনে হচ্ছে কষ্ট লাগাই স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু তখন আপনার বাজনা শুনতে শুনতে ভুলেই গিয়েছিলাম কষ্টের কথা। বাগেশ্রীর ওপর এতো সুন্দর আলাপ জীবনে আর কখনও আমি শুনিনি। এর মধ্যে আপনাকে ডেকে বিরক্ত করি কি করে বলুন তো।
প্রশংসা শুনে মিষ্টি করে হাসলো ভদ্রলোক। চমৎকার ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল।
আমার নাম রফিকুল ইসলাম। Businessman, ব্যস্ত মানুষ, সময় পাই না সাধবার। মাঝে মাঝে সারোদটা নিয়ে একটু বসি। কিন্তু তবলচি নেই এখানে ভালো–বড়ো অসুবিধা হয়। কিছুই বাজানো যায় না।
আমি অল-সল্প তবলা জানি। তবে আপনার সাথে সঙ্গতের মতো নয়।
আপনি জানেন বাজাতে? উজ্জ্বল হয়ে উঠলো শিল্পীর মুখ। আলমারির উপর থেকে এক জোড়া বাঁয়াতবলা পেড়ে বিছানার উপর রাখলো। তারপর বললো, আগে কফি খেয়ে নিই এক কাপ, তারপর কিছু একটা চেষ্টা করা যাবে, কি বলেন?
এক কাপ কফি এগিয়ে দিলো সে শহীদের দিকে, আরেক কাপ নিজে নিলো। কফি খেতে খেতে শহীদ তবলাটা বেঁধে নিলো। রফিকুল ইসলাম বললো, এই সময়টায় কোন রাগ শুনতে ইচ্ছে করছে আপনার বলুন তো?
ঝিঝিট ঠুমরী। একটু ভেবে উত্তর দেয় শহীদ।
ঠিক বলেছেন।
মিনিট কুড়ি ঝিঝিট চললো। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলে শহীদ। বড় মিষ্টি হাত। অদ্ভুত সুরজ্ঞান রফিকুল ইসলামের বাজনা শেষ হতেই শহীদ বললো, উঃ! আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আপনি গুণী। কোথায় শিখেছেন এমন পাগল করা বাজনা?
আমি কারো কাছে শিখিনি। যেটুকু পেরেছি শুনে শুনে শিখেছি। ওস্তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াবার সময় আমার ছিলো না। আপনি সত্যিকার সমঝদার, তাই আপনার কাছে ভালো লাগছে। আর কারো কাছে আমার বাজনা ভালো লাগবে না। আমি ওদের গ্রামার অনুসরণ কার না।
আমি তা বুঝেছি। কিন্তু পান্ডিত্য আর শিল্প দুটো আলাদা জিনিস। যা ভালো লাগে। যা মনকে মাতায় তাকে গ্রামার দিয়ে জবাই করা অন্যায়। আমার তো ধারণা ছিলো আবদুল করিম খাঁ সাহেবের বিঝিটের পরে আর কিছু সৃষ্টি হবে না। এইমাত্র আমার সে ভুল আমি শুধরে নিলাম।
রফিকুল ইসলাম দেরাজ টেনে একটা বোতল বের করলো। বললো, আপনার অভ্যেস নেই, তাই না?
Then excuse me. ছিপি খুলে চক চক করে কিছু বিলিতি raw gin গলায় ঢেলে বোতলের ছিপিটা বন্ধ করলো রফিকুল ইসলাম।
শহীদের সাথে তার আলাপ জমে উঠেছে। এরকম আলাপ আরও অনেকক্ষণ চলতে পারতো। শহীদের এতে ক্লান্তি নেই। আর অপর পক্ষেও যে নেই তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। এমন সময় দেয়াল ঘড়িতে টং টং করে রাত চারটে বাজলো। উঠে দাঁড়ালো শহীদ, আবার আপনার বাজনা শুনতে আসবো রফিক সাহেব, আজ আসি। আমার আবার সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। এখানে একটা জমি কিনবার ইচ্ছেয় এসেছি। একজন প্রফেসার কিছু জমি বিক্রি করছে, তার সাথে দরদস্তুর করতে হবে। আচ্ছা, আজ আসি।
গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো রফিকুল ইসলাম। অনাথ চক্রবর্তী লোকটা বেশ। তবলায় বেশ হাত আছে লোকটার। লয়জ্ঞানও ভালো, ছোটো খাটো রেলা বড় চমৎকার বাজায়। মনটাও বড় সুন্দর। তাছাড়া সমঝদার।
Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: কুয়াশা - ০১
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ০৭. কুষ্টিয়া কোর্ট
পরবর্তী :
Next post:০৯. বিছানায় শুয়ে শহীদ ভাবতে লাগলো »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *
COMMENT
NAME *
EMAIL *
WEBSITE
Search for:
0 Response to "কুয়াশা - ১ | পর্ব - ৮"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন