কুয়াশা - ১ | পর্ব - ৭
কুষ্টিয়া কোর্ট।
লাল স্টেশন ঘরটার গায়ে বড় বড় সাদা হরফে লেখা। সন্ধ্যা একটু ঘনিয়ে এসেছে। ট্রেন এসে থামলো। কয়েকজন যাত্রী নামলো। এদিকটা নিরালা-এরই মধ্যে সব নিঝুম হয়ে এসেছে। ছোটো স্টেশন ঘরটার পাশেই একটা চায়ের স্টল। বাতি জ্বলছে। কয়েকজন লোক বসে আছে বেঞ্চির উপর। কেউ বেঞ্চির উপর পা তুলে চাদর মুড়ি দিয়ে একেবারে জমে বসেছে। দোকানদার ঠক ঠক করে তাদের সামনে চায়ের গেলাস রাখছে।
ইন্টার ক্লাস থেকে একজন বাঙালী হিন্দু ভদ্রলোক নামলো। একটা চামড়ার বাক্স কুলির মাথায় তুলে দিয়ে এগিয়ে গেল ভদ্রলোক টিকেট চেকারের দিকে।
প্ৰথম দৃটিতেই বোঝা যায় সৌখিন লোক। দামী আদির পাঞ্জাবীর হাতা কিছুটা গোটানো। বোতামগুলো সোনার, চকচক করছে। একটু কুজো হয়ে হাঁটছে ভদ্রলোক। কিন্তু হাতের পেশী দেখে বোঝা যায় কি অসাধারণ শক্তি ছিলো তার যৌবনে। এখনও দুতিনজন ষন্ডামার্কা লোক তার সাথে লাগতে গেলে যথেষ্ট চিন্তা করে নেবে। টিকেট দেখিয়ে ভদ্রলোক বাইরে এসে একটা রিক্সায় চাপলো। বললো, আদর্শ হিন্দু হোটেল।
বাবু, তিনটে আছে হিন্দু হোটেল। কোনটায় যাবো?
গড়াই নদীর পাড়েরটায়।
রিক্সাওয়ালা বুঝলো এ লোক নতুন নয়। সে সোজা রিক্সা টেনে চললো। সেখান থেকে মিনিট দশেকের পথ। দোতলা হোটেল। একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, তাতে লেখাঃ আদর্শ হিন্দু হোটেল ও রেন্টুরেন্ট।
হোটেলের ম্যানেজার সাগ্রহে এগিয়ে এলো। দোতলায় নদীর ধারের বেশ বড় একটা ঘর ঠিক হলো। সাথে বাথরুমও আছে অ্যাটাচ্ড্। একটা ডবল বেড খাট ঘরটার প্ৰায় আধখান জুড়ে। আসবাবের মধ্যে একটা টেবিল, তার চারধারে চারটে চেয়ার পাতা। ঘরের কোণে একটা মাঝারি আকারের ডেসিং টেবিল। পূর্বদিকে একটা ছোটে ব্যালকনি। সেখানে দুটো ইজিচেয়ার পাতা নদীর দিকে মুখ করে। বেশ পছন্দ হয়েছে এ ঘরটা বোঝা গেল ভদ্রলোকের মুখ দেখে। ম্যানেজার একটা খাতা খুলে জিজ্ঞেস করলো, মশায়ের নাম কি লিখবো?
লিখুন অনাথ চক্রবর্তী।
পেশা?
জমিদারী।
আজ্ঞে কি কারণে আগমন? সবিনয়ে জিজ্ঞেস করে ম্যানেজার।
এখানে একটা জায়গা কেনার ইচ্ছে আছে।
কি যেন লিখলো খাতায় ম্যানেজার। তারপর সই করিয়ে নিয়ে খাতা বন্ধ করে ভালো করে চাইলো অনাথ চক্রবর্তীর দিকে। বললো, আজ্ঞে, খাওয়া সম্বন্ধে চিন্তাও করবেন না। আমাদের পাচক ব্রাহ্মণ। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। এখানে এই হোটেলই সব চাইতে ভালো। বড় বড় লোক সবাই এখানেই পদধূলি দান করেন। আপনার কোনও কিছুর প্রয়োজন হলেই আমাকে খবর দেবেন। আমার নাম আজ্ঞে, দিবাকর শর্মা।
এ শহরে বছর দশেক আগে একবার এসেছিলাম। এখন দেখছি অনেক পরিবর্তন।
আজ্ঞে হয়েছেই তো! আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আগে তো ভয়ানক নির্জন ছিলো এসব জায়গা। লোকালয় ছিলো ঐ মোহিনী মিলের কাছটাতেই। এখন এদিকেও কতো নতুন বাড়ি উঠলো আরও কতো হচ্ছে। আমি আজ্ঞে প্রায় বিশ বছর হলো এখানে এসেছি। আমার বাড়ি হলো গিয়ে কেশনগর।
ও। আচ্ছা আপনি আমার খাবার পাঠিয়ে দিন, আমি স্নান সেরে নিই। কলে জল আছে না?
আজ্ঞে আমাদের কলে সব সময়ই জল থাকে। আমরা পাম্প করে সাধারণ ব্যবহারের জল ট্যাঙ্কে তুলে রাখি। কিন্তু আজ্ঞে, নতুন জল, স্নান আজ অবেলায় না করলেই পারতেন।
দেখুন আমি খুব ক্লান্ত। স্নান করে কিছু মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আপনি তাড়াতাড়ি আমার খাবার বন্দোবস্ত করুন। আমার এমন স্নান করা অভ্যেস আছে, কোনও ক্ষতি হবে না।
বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক একটু মুচকি হাসলো। ভদ্ৰলোক আর কেউ নয়, আমাদের শহীদ খান।
স্নান সেরে আবার অনাথ চক্রবর্তী সেজে সে বেরিয়ে এলো। টেবিলে তার খাবার সাজানো রয়েছে। তাই খেয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। বাইরে থেকে আওয়াজ এলো, এটো বাসন নিতে এয়েছি কত্তা।
দরজা খুলে দিতেই একজন খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ছুঁচোমুখো কুঁজো বেঁটে লোক একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। পরিপাটি করে গুছিয়ে বাসন পেয়ালা তুলে সে অনাথ বাবুকে একটা নমস্কার করে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে শহীদ খাটে এসে শুয়ে পড়ল।
নানান কথা মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো। ট্রেনের সেই লোকটাকে খুঁজে বের করে তার উপর নজর রাখতে হবে। নদীর উপর নজর রাখতে হবে। কুয়াশাকে খুঁজে বের করার সূত্র সে পেয়েছে, তাই ধরে সে এগিয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন থাকতে হবে তার এখানে। জেদ চেপে গেছে শহীদের, যে করে হোক ধরতেই হবে খুনীকে। যতো বড় ধুরন্ধরই সে হোক না কেন, অন্যায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বেই। শহীদ হাসলো। কুয়াশার অনুচর ভাববে শহীদ আর কামাল এখনও গোয়ালন্দেই আছে।-এই শেষের লাশটারও হার্ট পাওয়া যায়নি। এমন অদ্ভুত ব্যাপার শহীদ আর কখনো শোনেনি। এক্স-রে দিয়ে ফটো তুলে ভেতরের খবর জানতে পারা আজ সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু উপরের চামড়ায় আঁচড়টুকু না দিয়ে হার্টটা কি করে গলিয়ে ফেলা যায়? অদ্ভুত বুদ্ধিমান এই খুনী। বুদ্ধির পরিচয় এর প্রতিটা কাজেই পাওয়া যাচ্ছে। দলবলও আছে লোকটার।
এসব নানান কথা এলোমেলো ভাবে তার মনে হতে লাগলো। সারারাত ভালো ঘুম হলো না। কানের কাছে মশার গুঞ্জন, মনে নানারকম চিন্তা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলো শহীদ।
অনেক বেলা করে পরদিন ঘুম ভাঙলো তার। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। পোস্ট অফিস থেকে গোটাকতক খাম কিনলো। তারপর থানার দিকে হাঁটতে থাকলো।
কুষ্টিয়ার রাস্তাঘাট বেশ ভালো। চিনতে কষ্ট হয় না। সবগুলোই সোজা সোজা। মেইন রোড থেকে অনেকগুলো রাস্তা লম্বাভাবে বেরিয়ে গিয়ে নদীতে পড়েছে। বাড়িগুলো রাস্তার পাশে সাজানো। মফঃস্বল টাউন। একটা গ্রাম্য পরিবেশের ছোয়া পাওয়া যায়। টাউনটা খুবই ছোটো, কিন্তু কিছুরই অভাব নেই। ষ্টেশন দুটো, একটা কুষ্টিয়া অপরটা কুষ্টিয়া কোর্ট, মাইল খানেকের তফাত। জজ কোর্ট, কোর্ট স্টেশনের সাথেই লাগানো। তার উত্তরে পুলিশ ব্যারাক। স্টেশনের পশ্চিমে কুষ্টিয়া কলেজ। তার সাথে লাগা কলেজ ফুটবল গ্রাউন্ড। হাসপাতালটা হচ্ছে গার্লস স্কুলের পাশেই, তার উত্তরে বয়েজ স্কুল। দুইটা সিনেমা হল রয়েছে এইটুকু শহরে।
থানার ঠিক উল্টো দিকেই তার এক বন্ধুর বাড়ি। জানা দরকার সে এখানেই আছে না ঢাকায় গেছে। সে থাকলে বড় উপকার হবে। সোজা গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো শহীদ। বেরিয়ে এলো একজন যুবক। দেখতে অত্যন্ত রোগা পটকা। তাই বয়স খুব কম বলে মনে হয়। চোখে চশমা, হাতে একটা বই। জিজ্ঞেস করলো, কাকে চান?
প্রফেসার আশরাফ চৌধুরী আছেন?
আমিই আশরাফ চৌধুরী। আপনার কি দরকার, ভিতরে আসুন না।
আমার নাম অনাথ চক্রবর্তী। রায়পুরার জমিদার। ঢাকার ইসলাম খান সাহেবের ছেলে শহীদ খান আমাকে আপনার সাথে আলাপ করতে উপদেশ দিয়েছেন।
আপনি বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? তা কেমন আছে শহীদ। প্রায় বছর খানেক হলো ওর সাথে আমার দেখা নেই। মাঝে শুনেছিলাম গোয়েন্দাগিরি করছে, এখনও তাই?
হ্যাঁ, এখনও তাই। গোয়েন্দাগিরি করতেই সে এখন কুষ্টিয়ায় এসেছে এবং তোমার সামনের চেয়ারে বসে আছে হাঁদারাম!
এ্যাঁ। আপনি? মানে তুমি? আমি চিনতেই পারিনি।ভালো৷ ছদ্মবেশ ধরেছো তো হে, উঠেছে৷ কোথায়?
আদর্শ হিন্দু হোটেল।
বাদ দাও তোমার হোটেল। চলো এখনই জিনিসপত্র নিয়ে আসি আমার এখানে। কুষ্টিয়ায় এলে অথচ আমার বাসায় উঠলে না, আমি ভীষণ অসন্তুষ্টি হয়েছি।
দেখো ভাই বিশেষ কাজে খুনী তাড়া করে এসেছি, তাই হোটেলে উঠতে বাধ্য হয়েছি। নইলে তোমার এখানেই উঠতাম। আপাততঃ আমাকে হিন্দু জমিদার হয়ে থাকতে হবে। তুমি কিছু মনে করো না।
বেশ তো, এখন থাকো। কিন্তু কাজ হয়ে গেলে আমার এখানে কদিন বেড়িয়ে না গেলে আমি অত্যন্ত রাগ করবো।
আচ্ছা, আচ্ছা। আপাততঃ তুমি আমাকে কিছু খবর দাও দেখি। এখানে বিক্রি হবে এমন জমিটমি আছে?
খুব আছে। আমরাই তো কিছু জমি বিক্রি করবো। কেন কিনবে নাকি?
না, কিনবার-ভান করবো। আমি তো হিন্দু জমিদার। জমি কিনতে এসেছি। তোমাদের জমি থাকায় ভালোই হলো। তুমি মাঝে মাঝে জমির দলিল, নক্সা, পরচা ইত্যাদি নিয়ে আমার ওখানে যেতে পারবে, আমিও পারবো আসতে। তোমার কাছ থেকে অনেক খবর জানবার প্রয়োজন হবে। এখন চলি।
তুমি ঠিকানা দিয়ে যাও, আমি যাবো।
শহীদ একটা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে আশরাফ চৌধুরীর হাতে দিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি কাল বিকেলের দিকে একবার যেও আমার ওখানে।
এখনি উঠছো নাকি? চা-টা খাবে না?
না ভাই, আর বসবো না। কতকগুলো কাজ পড়ে রয়েছে।
হোটেলে ফিরে চিঠি লিখতে বসলো শহীদ। লীনাকে লিখলো যেন কিছুমাত্র চিন্তা না করে। সে, কামাল ভাই, গফুর সবাই খুব ফুর্তিতে রয়েছে। দিন পনেরোর মধ্যে ফিরবে।
কামালকে লিখলো, আমি যখনই টেলিগ্রাম করবো তখুনি তুই গফুরকে নিয়ে ছদ্মবেগে চলে আসবি কুষ্টিয়ায়। হিন্দু সেজে আসবি। আমি এখন রায়পুরার জমিদার অনাথ চক্রবর্তী। তুই আমার নায়েব অবিনাশ সেরেস্তাদার আর গফুর পেয়াদা। ওকে সব বুঝিয়ে দিবি আগে ভালো করে। কুষ্টিয়া আদর্শ হিন্দু হোটেল, গড়াই নদীর পাড়…
সেই বেটে চাকরটার হাতে চিঠি দুটো দিয়ে একটা আধুলী গুজে দিলো শহীদ। সে জিজ্ঞেস করলো, বাবু, লাল বাক্সে ফেলাবো, না নীল বাক্সে?
লাল বাক্সে ফেলে দাও। এখুনি যাও। জরুরী চিঠি।
সে চলে গেল চিঠি নিয়ে। শহীদ ভাবতে লাগলো, আজকের মতো কাজ শেষ। বিকেল বেলা নদীর পাড় ধরে গিয়ে যতদূর সম্ভব দেখে আসতে হবে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে অর্ধেক পড়া ইংরেজি উপন্যাসটা নিয়ে ব্যালকনির একটা ইজিচেয়ারে গিয়ে বসলো শহীদ। উত্তর দিক থেকে ফুরফুরে একটা ঠান্ডা বাতাস আসছে। বেশ ভালো লাগে। মনটা কিছুতেই বইয়ে বসতে চায় না। বই বন্ধ করে সে সামনের দিকে চেয়ে রইলো।
নদীর জল অনেক শুকিয়ে গেছে। পাড় খুব উচু— যেন চোয়ালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু এই জলেও অনায়াসে স্টীমার চলতে পারে। ছোটো বড় হরেক রকম নৌকো চলছে। কারও পাল তোলা, কেউ বা দাঁড় টানছে। অনেক দূরের পাল তোলা গয়না নৌকো দেখলেই মনটা উদাস হয়ে যায়। দূরের টান– মাঝিদের অলস কথাবার্তা–জলের একটানা শব্দ- হালের বিলম্বিত ক্যাচ-কুচ শব্দ– খরা-আমেজ -দুপুর-সবটা মিলিয়ে স্বপ্ন মনে হয়।
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো শহীদ। সেখান থেকে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো চুপচাপ। আকাশে একবিন্দু মেঘ নেই। কয়েকটা চিল অনেক উচুতে উড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে একটা নিঝুমতা। দূরে কোনও একটা বাড়ির ছাত পেটানো হচ্ছে। সেই একটানা শব্দ দুপুরকে আরও গম্ভীর করে তোলে। হঠাৎ একটা কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে। খান খান হয়ে যায় নিস্তব্ধতা। আবার জমে ওঠে আমেজ। ঝিমিয়ে আসে শহীদ। দুপুর এতো সুন্দর হতে পারে তার ধারণাই ছিলো না। একটা মধুর আমেজ তার বুদ্ধিক ছেয়ে ফেলে। এ দুপুরকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়, বুদ্ধি দিয়ে নয়।
বিকেল বেলা একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল শহীদের। হরিদাস চা নিয়ে এসে রাখলো। চোখ কচলে উঠে বসলো শহীদ। ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাবতে তার লজ্জাই লাগছে। দুপুরে ঘুমোনো ওর অভ্যেস নেই। দিবা-নিদ্ৰাকে রীতিমত ঘৃণাই করে সে। আর আজ নিজেই পাকা তিনঘন্টা দিবা-নিদ্রা দিয়ে উঠলো। কিন্তু এ অপরাধের জন্য তার গ্লানি নেই। শরীর মন বড় চাঙা বোধ হচ্ছে।
চা খেয়ে সে বেরিয়ে পড়লো নদীর পাড়ে বেড়াতে। সরু একটা রাস্ত৷ বরাবর নদীর পাশ দিয়ে চলে গেছে। বিকেলে আজকাল কেউ বড় একটা এদিকে আসে না। সবাই যায় পুলিশ গ্রাউন্ড কিম্বা কলেজ গ্রাউন্ডে হকি ক্রিকেট খেলা দেখতে। দুচারজন অতি-বৃদ্ধকে দেখা গেল নদীর নির্মল বায়ু সেবন করছেন। কেউ কেউ কোনও পাথরের পর কি গাছের গুড়িতে বসে আছেন। পথ ধরে কিছু উত্তরে গিয়ে শহীদ দেখলো একজন যুবক একটা পাথরের উপর বসে ওপারের চড়ার দিকে চেয়ে রয়েছে। কাছে যেতেই তার দিকে ফিরে চাইলো। তারপর আবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ওপারে। শহীদ দেখলো, অদ্ভুত সুন্দর দুটি চোখ। নিস্পাপ, নিষ্কলঙ্ক। চোখের দিকে চাইলে মনে হয় কতো গভীর যেন মানুষটি, যেন সাগর। কতো কি তার অতল তলে আছে লুকোনো। কবি হওয়া এরই সাজে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। পরনে জিনসের সাদা প্যান্ট আর হালকা গোলাপী রঙের শার্ট। বড়ো মানিয়েছে এই পড়ত বেলায় লোকটাকে এই কাপড়ে। বয়স ঠিক আঁচ করা যায় না- বোধ হয় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। লম্বা-চওড়া শরীরের গড়ন। চওড়া উচু বুক শার্টের উপর দিয়েও স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
শহীদ এগিয়ে যাচ্ছিলো, এমন সময় পিছন থেকে কে ডাকলো, অনাথ বাবু।
চমকে ফিরে তাকালো শহীদ। দেখলো ট্রেনের সেই লোকটা দ্রুত গতিতে তার দিকে আসছে। হাতে একটা অ্যাটাচি কেস। লোকটা কাছে এসেই বললো, দেখুন তো, পেছন থেকেও ঠিক চিনতে পেরেছি কেমন। হাওয়া খাচ্ছেন বুঝি?
হ্যাঁ, এই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি। লোকটার নামটা কিছুতেই মনে আনতে পারছে না শহীদ। ট্রেনে কি যেন একটা নাম বললো? একটু থেমে শহীদ আবার বললো, ত৷ আপনি এদিকে চললেন কোথায়? খুব তাড়া বুঝি?
এই তো, এই পথে আর একটু এগোলেই আমার বাসা। চাকরি করি সেই মোহিনী কটন মিলে। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হলে একটু তাড়াতাড়ি হাটতে হয় বৈকি। বাসায় স্ত্রী আছেন কিনা, বুঝলেন না, তার হুকুমেই, মানে সাঁঝের আগেই ফিরতে হয়। চলুন না আমার বাসায় একটু চা খাবেন। গল্প-সল্প করা যাবে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখন হোটেলে ফিরবো। আরেকদিন আপনার বাসায় চা খাওয়া যাবে, আজ আসি। শহীদ এক পা বাড়ালো।
ও, ভালো কথা, আপনার জমি কিনবার কি হলো? খোঁজ খবর পেলেন কিছু?
এই একটু আধটু খোঁজ পেয়েছি। আশরাফ চৌধুরী আছেন না, এখানকার কলেজের প্রফেসার, তিনি নাকি কিছু জমি বিক্রি করছেন। দেখি কথাবার্তা দামদর করে কি দাঁড়ায়।
ইংরেজির প্রফেসার আশরাফ চৌধুরী তো? উনি লোক খুব ভালো। তাঁর সাথে কারবারে আপনি ঠকবেন না। আচ্ছা, আজ আসি, আবার দেখা হবে।
দুজন দুদিকে চলে যায়। সেই লোকটি তখনও পাথরের উপরে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওপারের দিকে। সন্ধ্যা নামছে। আবছা হয়ে আসছে ওদিকের পাড়টা। কুয়াশা পড়ছে। দূরে একটা মন্দিরে ঘন্টা ধ্বনি হচ্ছে। কয়েকটা বাদুড় মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। নৌকোগুলোর কোনও কোনোটাতে আলো জ্বলছে। জলে তার প্রতিবিম্ব। কোনো এক বাড়িতে মশা তাড়াবার জন্যে ধূপ পোড়াচ্ছে, তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মন্দিরে ঘন্টা পড়ছে টং টং। হোটেলে ফিরে এলো শহীদ। এতোক্ষণে মনে পড়েছে। লোকটার নাম সিরাজুল হক।
Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: কুয়াশা - ০১
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ০৬. গোয়ালন্দ থানার দারোগা
পরবর্তী :
Next post:০৮. রাত দেড়টা »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *
COMMENT
NAME *
EMAIL *
WEBSITE
Search for:
0 Response to "কুয়াশা - ১ | পর্ব - ৭"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন