কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১০
কামালের চিঠি এলো। সে তার কথামতো কাজ করছে।
রফিকুল ইসলাম সম্বন্ধে আশরাফ চৌধুরীর কাছে অনেক কিছু জানতে পারলো শহীদ। আশরাফ অকুণ্ঠ প্ৰশংসা করেছে এই মানুষটার। বছর তিন হলো কুষ্টিয়ায় ব্যবসা করছে। অতি ভদ্রলোক। প্রচুর টাকা করেছে ব্যবসা করে।
রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ দেখে এসেছে শহীদ রফিকুলের সঙ্গে আজ দুদিন হলো। রোজ রাতে আসর বসে। রফিকুল ইসলামের বাড়ির উপরতলার একটা অংশ একেবারে তালা বন্ধ থাকে। শহীদ জিজ্ঞেস করায় রফিক হেসে বললো, একা মানুষ, কে থাকবে এতো বড় বাড়িতে চাকর আছে একটা, সে একতলার সম্পূর্ণটা জুড়ে থাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই তিনখানা ঘরের বেশি জুড়তে পারিনি। ওদিকটা খালিই পড়ে থাকে, তাই বন্ধ করে দিয়েছি।
ভাড়া দিলেই পারো। শহীদ বলে।
মফঃস্বল শহর, কে ভাড়া নেবে। তাছাড়া আমার সঙ্গীতের ধাকায় দুদিনেই ভাড়াটে পালাবে।
দুজনে হাসে। এতো কম সময়ে তাদের এতো গভীর বন্ধুত্ব জমে উঠবে কে, ভাবতে পেরেছিল? শহীদ কামালকে লিখেছে তার বন্ধুর কথা। লিখেছে, যেদিন শুনবি বাজনা, কেবল মাত্র সেদিনই বুঝবি, কী অদ্ভুত ভালো বাজায়।
সেদিন রাত দশটায় হোটেলে ফিরে আসছে শহীদ। হোটেলের দরজার কাছে আসতেই একজন লোক ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল পাশ কাটিয়ে। একবার তার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে শহীদ উপরে উঠে গেল। তার ঘরের দরজা খোলা। আশ্চর্য হয়ে গেল শহীদ ঘরে ঢুকে। সমস্ত ঘরে তার জিনিসপত্র ছড়ানো। কে যেন তার বাক্স ঘেঁটেছে লন্ড ভন্ড করে। প্রায় সবকিছুই বের করে মাটিতে টাল দেয়া। এক জোড়া স্যুট, কয়েকটা শার্ট, পাজামা, ধূতি, পাঞ্জাবী, সব মাটিতে বের করা রয়েছে। মেকআপ করবার জন্যে যে সব পরচুলা, পেইন্ট তার বাক্সে ছিলো, সবগুলোই মাটিতে নামানো। শহীদ লক্ষ্য করে দেখলো কিছুই চুরি যায়নি। টাকা আর রিভলবার তার সাথেই ছিলো।
মহা ভাবনায় পড়লো শহীদ। তাহলে কি কুয়াশার দৃষ্টি পড়েছে তার উপর। নাকি বেটা ছিচকে চোর? কিন্তু তাহলে জিনিস কিছুই চুরি হলো না কেন? দেখা যাক কি হয়, শহীদ ভাবে। তবে সাবধানে থাকতে হবে। পুলিসে খবর দিয়ে লাভ নেই, শুধু শুধু হাঙ্গামা করবে পুলিস এসে। হয়তো হরিদাসকে ধরেই মারতে লেগে যাবে। একবার ভাবলো রফিকের বাসায় উঠে যাবে কিনা।
জিনিসপত্র তুলে যথাস্থানে সাজিয়ে রাখলো শহীদ। কাউকে কিছু জানালো না। কিছুক্ষণ পর হরিদাস এসে বললো, বাবু আপনাকে একজন খুঁজতে এসেছিল সোন্দোর পর।
তার নাম বলে গেছে?
আজ্ঞে না। আমি জিজ্ঞাসা করেছেলাম। বুললো না। আমি বুললাম আপনি রফিক সাহেবের বাসায় যেয়েছেন। সে নোক অনেকক্ষণ নিচের রেস্টুরেন্টে বইসেছেল আপনার জন্যি। তারপর কখন যে উইঠে চইলে গেল দেখিনি। আপনার সাথে দেখা হোইনি বাবু?
না হয়নি। আবার কখন আসবে লোকটা বলে গেছে?
না বাবু।
কি রকম দেখতে লোকটা?
বাইটে মতোন। মোটাসোট। হাতে একটা ছোট বাক্স ছেলো। সাদা শার্ট আর পাজামা পইরে ছেলো।
শহীদ খেয়াল করে দেখলো আজ হোটেলে ঢুকবার সময় পিছন থেকে যাকে দেখেছে তার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে ওর বর্ণনা। একটা টাকা বের করে হরিদাসের হাতে দিয়ে বললো, আচ্ছা, তুমি এখন যাও হরিদাস। এরপর কেউ আমাকে খোঁজ করলে তাকে বসিয়ে রেখে আমাকে খবর দেবে।
হরিদাস চলে যাচ্ছে, তাকে আবার ডেকে শহীদ বললো, এখন চা পাওয়া যাবে না হরিদাস?
আজ্ঞে রাত বারোটা পর্যন্ত পাবেন।
কফি নেই।
আজ্ঞে, তাও আছে।
বাঃ। শহীদ খুশি হয়—এক কাপ কফি ভালো করে বানিয়ে আনে৷ তো।
ব্যালকনিতে বসে অনেকক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে কফিটুকু খেলো শহীদ। তার মাথার মধ্যে জট পাকাচ্ছে একসাথে বহু চিন্তা। সে এখানে এসেছে খুনীর অনুসন্ধানে আজ পাঁচ ছয় দিন। কিন্তু কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে সে? আজ হয়তো সে কুয়াশার তীক্ষ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গেছে।
পর পর অনেকগুলো সিগারেট ধ্বংস করলো শহীদ গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায়। তার মুখে একটা দুর্বোধ্য রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো ধীরে ধীরে।
পরদিন নারাণ বাবুর সাথে দেখা করলো শহীদ রফিকুল ইসলামের সাথে গিয়ে। আরও কয়েকখানে গেল। আশরাফ চৌধুরীর বাড়িতেও একবার গিয়ে ঢু মেরে এলো। পথে ট্রেনের সেই সিরাজুল হকের সাথে দেখা। আদাব বিনিময় হলো। রফিক জিজ্ঞেস করলো, এই ভদ্ৰলোক, কে?
আমার সাথে ট্রেনে পরিচয়। বড্ডো গায়ে পড়ে আলাপ করছিল তাই প্রথমে আমার খারাপ লোক বলে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার নদীর ধারে দেখা। মোহিনী মিলে কি একটা কাজ করে যেন বললো।
মোহিনী মিলে? অসম্ভব। আমি নানান ব্যাপারে প্রায়ই যাই মোহিনী মিলে। ওখানকার সব লোক আমার চেনা। এ লোক নিশ্চয়ই নতুন এসেছে কুষ্টিয়ায়। ছোট শহর এটা। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের সবাই সবাইকে চেনে। তোমার কাছে মিছে কথা বলেছে লোকটা।
গতরাতের ঘটনা মনে পড়লো শহীদের। রফিকুল ইসলামকে বললো ব্যাপারটা। রফিক চিন্তিত হয়ে বললো, তাই তো। তোমার পেছনে চোর ছাচ্চোর লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। well planned বলেই বোধ হচ্ছে, সেই ট্রেন থেকে follow করেছে তোমাকে। তুমি একটু সাবধানে থেকো। আর আপাততঃ চলো সোজা মোহিনী মিলে যাই। ওদের attendance register দেখলেই বোঝা যাবে সিরাজুল হক বলে কেউ ওখানে কাজ করে কিনা সত্যি সত্যিই।
রিক্সা ঘুরিয়ে ওরা মোহিনী মিলে গিয়ে উপস্থিত হলো। কর্মচারীদের অনেকেই রফিকুল ইসলামকে সসম্মানে সালাম দিলো। ম্যানেজার কি কাজে অফিস থেকে বাইরে এসে রফিককে দেখে হৈচৈ করে ডাকাডাকি শুরু করলেন। এ জায়গায় রফিকুল ইসলামের খুবই প্রতিপত্তি আছে বোঝা গেল। সেটা হয়েছে ম্যানেজারের সাথে বন্ধুত্বের পর থেকে।
খোঁজ করে দুজন সিরাজুল হক বেরোলো। ম্যানেজারের হকুমে তারা সামনে এসে দাঁড়ালো। আর কোনও সিরাজুল হক নেই। শহীদ আর রফিক অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এলো। কেউ লক্ষ্য করলো না, একজন লোক ম্যানেজারের অফিসের অদূরেই একটা গাছের আড়াল থেকে সব দেখলো। তারপর ধীর পদে বাজারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: কুয়াশা - ০১
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ০৯. বিছানায় শুয়ে শহীদ ভাবতে লাগলো
পরবর্তী :
Next post:১১. কামালকে টেলিগ্রাম করলো শহীদ »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *
COMMENT
NAME *
EMAIL *
WEBSITE
Search for:
0 Response to "কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১০"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন