Ads Golpo.Best Kobita.Best

search

কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১২


ফুটফুটে অন্ধকার ঘরটা। জ্ঞান ফিরে পেলেন হেকমত আলী। কেমন যেন ঘোলা লাগছে সব কিছু। ধীরে ধীরে সব কথা মনে পড়লো তাঁর। একটা খশ খশ শব্দ শুনে জেগে যান তিনি। প্রায় সারারাত জেগে থেকে কাশেন, তাই ঘুম অত্যন্ত পাতলা তাঁর। জেগে গিয়ে তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে?

একটা রুমাল দিয়ে তার নাক মুখ চেপে ধরলো যেন কে। একটু ধস্তাধস্তি করেন হেকমত আলী। তাঁর দুর্বল শরীর নির্জীব হয়ে আসে। একটা মিষ্টি গন্ধ, কেমন আবেশ মাখানো। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে গেল তাঁর। আর কিছুই মনে পড়ছে না।

ঐতো। সেই কালো মূর্তিটারাতে যার সাথে ধস্তাধস্তি করেছেন হেকমত আলী। উঠে বসবার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু পারলেন না। খাটের সাথে তাঁকে বেল্ট দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। একটা ভেন্টিলেটার দিয়ে সামান্য আলো আসছে সেই ঘরে—সেদিকে তাকিয়ে বুঝলেন, এখন দিন। একটা অন্ধকার ঘরে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে।

ততক্ষণে মূর্তিটা বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমাকে কেন আটকে রেখেছো? আমার টাকা পয়সা নেই, রুগী মানুষ, ছেড়ে দাও আমাকে।

টাকা পয়সা আমার অনেক আছে, হেকমত সাহেব। আপনার কাছে চাই না।

তবে? আর কি চাও আমার কাছে?

ঘরের মধ্যে বাতি জ্বলে উঠলো। কালো আলখেল্লা পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের মধ্যে। কেমন যেন চেনা ঠেকছে চেহারাটা। লোকটা বললো, আপাততঃ আপনার জ্ঞান ফিরে আসাটা চাইছিলাম।

ঘরের এক কোণে আর একজন লোককে দেখা গেল। নিকষ কালো তার গায়ের রঙ। একটা হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরনে। খুব রোগা লোকটা। একটা টেবিলের ওপর নানান আকারের কতগুলো যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখছিল সে। আলখেল্লা পরা লোকটার দিকে ফিরে বললো, সব ঠিক আছে, হুজুর। মাইক্রোস্কোপটা আমি পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসছি।



পাশের ঘরে চলে গেল সে। আলখেল্লা পরা লোকটা এবার ঠেলা দিয়ে খাটটা টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। খাটের পায়াতে রবারের চাকা লাগানো। নিঃশব্দে সেটা গড়িয়ে চলে এলো। একটা যন্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো লোকটা।

আমাকে নিয়ে কি করতে চাও? হেকমত আলী সভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

করতে চাই। যন্ত্রটা নামিয়ে রাখলো লোকটা টেবিলের উপর। অনেক কিছুই করতে চাই, হেকমত সাহেব। আজ আমার সারা জীবনের সাধনার হয় ফল লাভ করবো, নয়তো চিরকালের জন্যে শেষ হয়ে যাবো। আজ ছয় ঘণ্টার মধ্যে আপনি হয় যক্ষ্মার হাত থেকে বেঁচে যাবেন, নয়তো মৃত্যুবরণ করবেন। ও কি, চমকে উঠবেন না। মরতে তো আপনাকে হবেই, আজ যদি একটা মহৎ উদ্দেশ্যে আপনি মারা যান তাহলে কি আপনার মৃত্যু মহিমামন্ডিত হয়ে উঠবে না? আর যদি successful হই, তবে পৃথিবী থেকে ক্ষয় রোগ চিরকালের জন্যে দূর হয়ে যাবে।

আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আরোগ্য চাই না। যে কটা দিন পারি, সে ক টা দিন আমি বাঁচতে চাই।



আপনি চাইলেও আপনাকে ছাড়া হবে না। আমার পরীক্ষা আমি করবোই। কারও সাধ্য নেই তা ঠেকাবার। আমাকে বাঁধা দেবার জন্যে গুলিও ছুড়েছিলেন, পেরেছেন আটকাতে। এই গবেষণার জন্যে আমি কতো মানুষ খুন করেছি-ডাকাতি করে টাকা যোগাড় করেছি। এখন আপনার অনিচ্ছায় সবকিছু আমি ভেস্তে দেবো বলতে চান, হেকমত সাহেব?

মাইক্রোকোপ নিয়ে কালো লোকটা ফিরে এলো। সাবধানে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো যন্ধটা। প্যান্টের দু পকেট থেকে দু বোতল স্কচ হুইস্কি বের করে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখলো। আলখেল্লাধারী বললো, হেকমত সাহেবের গায়ের জামা সব খুলে ফেলো তো। আরে, ও কি করছো? কেবল শার্ট আর গেঞ্জি, পাজামা থাক।

হেকমত সাহেবের গা থেকে শার্ট আর গেঞ্জি খুলে ফেললো কালো লোকটা। সব কটা হাড় দেখা যায়। ভয়ে তার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। টেবিলের উপর যন্ধটা বসিয়ে তার মুখটা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ঠিক হেকমত আলীর বুকের দিকে ফিরিয়ে আলখেল্লাধারী একটা সুইচ টিপে দিলো। তারপর বললো, এখন থেকে ছ ঘন্টা পর আমার গবেষণার ফল জানতে পারবো। আপনার শরীর খুব দুর্বল তাই খুব কম পরিমাণে sound পাঠাতে হচ্ছে। আরও তাড়াতাড়ি কাজ সারা যেতো যদি পয়েন্ট জিরো ওয়ান কিলোসাইকলসে সেটা পাঠাতে পারতাম।



হেকমত সাহেব কিছুই বুঝলেন না। কেমন যেন বিম বিম করছে মাথাটা। আড়ষ্ট

কষ্ঠে বললেন, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

আলখেল্লাধারী একটা বোতল তুলে নিয়েছিপি খুলে বেশ অনেকখানি তরল পদার্থ গলায় ঢাললো। তারপর একটু কেশে গলা পরিস্কার করে বললো, বুঝতে পারছেন না? আপনি আল্টা সোনিক্স সম্বন্ধে কিছু জানেন?

নাম শুনেছি। অতি শব্দ। যে শব্দ শোনা যায় না।

ঠিক ধরেছেন। কিন্তু হয়তো জানেন না, এই আলা সোনিক্স দিয়ে কতো বড় বড় কাজ করা যায়। আমি এটা নিয়ে গবেষণা করেছি সুদীর্ঘ পনেরো বছর। এই যে যন্ত্রটা দেখছেন আপনার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে, এটা অনবরত অতি সূক্ষ্ম শব্দ তরঙ্গ পাঠাচ্ছে আপনার বুকের দিকে। ফলে ক্ষয় রোগের যতো জীবাণু আসছে হার্টে, আর যতো বীজানু বহুদিন থেকে বাসা বেঁধেছে লাংসে, সব মারা পড়ছে। ছ ঘন্টার মধ্যে সব মরে ভূত হয়ে যাবে, যদি আমার হিসেব ঠিক হয়ে থাকে। তারপর আপনি ভালো খাওয়া দাওয়া করলে তিন মাসের মধ্যে আবার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন।

হেকমত আলীর মাথাটা বিমঝিম করছে। ঠিকমত কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না। বললেন, বুঝেছি, আপনি বৈজ্ঞানিক। আমিও সাইন্স পড়েছি। আমি বিজ্ঞানের মর্যাদা বুঝি। আপনার গবেষণার ফলে আমার যদি প্ৰাণ যায় তবু আপনার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ থাকবে না।

এই তো চাই, হেকমত সাহেব।

বলা তো যায় না-আমি হয়তো যে কোনো মুহুর্তে মারা যেতে পারি। আপনি নিরাপদ হবার জন্যে আমার স্বীকারোক্তি লিখে নেন।

তার দরকার হবে না। প্রথম কথা, আপনি মারা যাবেন না। দ্বিতীয় কথা, যদি আপনি মারাও যান, কাল গোয়ালন্দে নদীর মধ্যে আপনার লাশ পাওয়া যাবে। এ রকম আরও বহু লোককে আমি খুন করেছি। আমারই নাম কুয়াশা।

কালো লোকটাকে কুয়াশা বললো, তুমি এখানে থাকো। উনি পানি খেতে চাইলে দিও। এখন বেলা বাজে চারটা, আমি সাড়ে নয়টায় আসবো আবার। তার মধ্যে কিছু ঘটলে তক্ষুণি আমাকে জানাবে।



একটা বোতল টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো কুয়াশা, হেকমত আলী বাধা দিলেন। বললেন, আপনার পরীক্ষা শেষ হবে ছ ঘন্টা পর, তার মধ্যেই আপনি পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যাবেন।

পুলিসের নামে চমকিত হলো কুয়াশা। বললো, পুলিস?

আপনি জানেন না, আপনাকে ধরবার জন্যে ঢাকার প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খান কুষ্টিয়ায় এসেছেন।

আশ্চর্য হয়ে গেল কুয়াশা। সামলে নিয়ে বললো, আপনি জানলেন কি করে?

সে তো আমাদের বাসায় গিয়েছিল। সে-ই তো আমার মেয়ের কাছে একটা বন্দুক রেখে গেছিলো। আমাদের তো বন্দুক নেই। তার বন্দুক দিয়েই কাল রাতে প্রথমবার আপনাকে তাড়ানো হয়েছিল।

আচ্ছা, বন্দুকের রহস্য তবে এই! ভেবেই পাচ্ছিলাম না আপনাদের কাছে বন্দুক.এলো কি করে। তাহলে আপনি বলতে চান শহীদ খান আমাকে চেনে? সে জানলো কি করে যে কাল আপনার বাড়িতে হানা দেবো? ব্যাপারটা ঘোরালো ঠেকছে। তবে কি ধরা পড়ে গেলাম! স্বগতোক্তির মতো বলে কুয়াশা।

সে এখনো আদর্শ হিন্দু হোটেলে অনাথ চক্রবর্তী নাম নিয়ে রয়েছে।

এ্যাঁ! কি বললেন? অনাথ চক্রবর্তী চমকে উঠলো কুয়াশা। কপালে অনেকগুলো কুঞ্চন রেখা পড়লো।

হেকমত আলীর চিন্তা ক্রমেই আড়ষ্ট হয়ে আসছে। কি বলছেন নিজেই বুঝতে পারছেন না ভালো করে। একবার তাঁর মনে হলো, যা বলছেন হয়তো ঠিক হচ্ছে না বলা। আবার ভাবছেন, বলেই ফেলি, কি আর হবে। তার মুখের দিকে চেয়ে কুয়াশা এগিয়ে এলো। আপনার কষ্ট হচ্ছে? মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে কেন?

কি জানি। কেমন যেন লাগছে। কিছুই ভাবতে পারছি না। একটু পানি!

লোকটাকে ইশারা করতেই সে এক গ্লাস পানি আনতে গেল। যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলো কুয়াশা। পানি খেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে চিৎকার করে উঠলেন হেকমত আলী, ছেড়ে দাও আমাকে। আর কষ্ট দিয়ো না।



কুয়াশা মুচকে হাসলো, তারপর যন্ত্রটা আবার চালু করে দিলো।

আপনি পালিয়ে যান বৈজ্ঞানিক। শহীদ খান আপনাকে ধরবে।

সে চেনে আমাকে? আমিই যে কুয়াশা তা সে জানে?

হ্যাঁ, বলেছিল তো চেনে, কেবল প্রমাণের অভাবে ধরতে পারছে না। শান্ত গলা হেকমত আলীর।

তার সাধ্য নেই এইখানে আসবার। কালু তুই এই যন্ত্রটা নিয়ে ছাতে চলে যা। কেউ বাড়ির ভেতর ঢুতে চেষ্টা করলেই এই বোতাম টিপবি। আজ দরকার হলে আমি হাজার হাজার মানুষ খুন করবে, তবু আমার গবেষণা রেখে পালিয়ে যাবো না।

হেকমত সাহেব ঝিমিয়ে এসেছেন। তাঁকে দিয়ে এখন যা খুশি বলিয়ে নেয়া যায়। কুয়াশা হাসে। ভাবে, আর কিছু না হোক, এ যন্ত্র দিয়ে আসামীর স্বীকারোক্তি বের করা যাবে। পৃথিবীকে সে কতো বড় একটা জিনিস দান করছে, অথচ পৃথিবীর মানুষই তাকে বাঁধা দেয়ার জন্যে কেমন আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

শহীদের সাথে আর কে আছে, হেকমত সাহেব? কুয়াশা জিজ্ঞেস করে।

তার বন্ধু কামাল আহমেদ। সে অবিনাশ সেরেস্তাদার নাম নিয়ে ওর সাথে আছে।

কুয়াশা বুঝলো হেকমত আলী ভুল বকছেন না। প্রকৃতিস্থ তিনি সত্যিই নেই। কিন্তু যা বলছেন তা সত্য। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেও সত্যি কথা বলছেন তিনি

একটা রাইটিং প্যাড নিয়ে এসে টেবিলে বসে কি সব লিখতে আরম্ভ করলো কুয়াশা। হেমত আলী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কয়েক ঢোক মদ খেয়ে নেয় কুয়াশা।

দু ঘন্টা পর চোখ খুলে পানি চাইলেন হেকমত আলী। যন্ত্র বন্ধ করে খানিকটা ব্রান্ডি ঢেলে দিলো কুয়াশা তার গলায়।

আমাকে মেরে ফেলো। আর পারি না। আমাকে মেরে ফেলো।

আবার শুরু হলো শব্দ-তরঙ্গ। ঝিমিয়ে এলেন হেকমত আলী। কুয়াশা লিখে চলেছে একমনে। মাঝে মাঝে কলম উঁচু করে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবছে।

Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: কুয়াশা - ০১
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ১১. কামালকে টেলিগ্রাম করলো শহীদ
পরবর্তী :
Next post:১৩. রাত সাড়ে নয়টা »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *

COMMENT


NAME *


EMAIL *


WEBSITE




Search for:

0 Response to "কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১২"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন