Ads Golpo.Best Kobita.Best

search

কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১৩


রাত সাড়ে নয়টা। দোতলা একটা বাড়ির চারদিকে অনেকগুলো একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। ছাতের উপর একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার হাতে কিসের একটা বাক্স। ছাত্রের কার্নিশ ধরে অনবরত ঘুরে চলেছে লোকটা বাড়িটার চারদিকে দেয়ালের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে। চারজন কনেষ্টবল, একজন দারোগা, শহীদ আর কামাল এগিয়ে আসছে বাড়িটার দিকে। দূর থেকেই শহীদের নজর গেল ছাতের ওপর। থেমে গেল সে।

ঐ দেখুন, ছাতের ওপর যন্ত্র হাতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে একজন লোক।

এখান থেকে গুলি করি, বললেন দারোগা সাহেব।

না, ও এখনও টের পায়নি। গুলি মিস করলে এক সেকেন্ডে আল্লার কাছে চলে যাবো আমরা।

আমার গুলি কোনদিন মিস হয় না। দারোগা রিভলবার তুললেন।

আহ! পাগলামি করবেন না, দারোগ৷ সাহেব। আরও যন্ত্র এবং আরও লোক নেই তা কে বললো আপনাকে আপনার দোষে কুয়াশাকে তো হারাবই, প্ৰাণটাও যাবে। আমার কথা শুনুন। যতক্ষণ না বাড়ির ভেতর ঢুকবার চেষ্টা করছি আমরা ততক্ষণ কেউ কিছু বলবে না। আমরা কেউ তো ইউনিফর্ম পরে নেই। আমি আর কামাল বাড়িটার পেছন দিকে চলে যাই। আপনারা সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকুন। লোকটার দৃষ্টি যখন আপনাদের দিকে যাবে তখন ও সেদিকেই নজর রাখবে বেশি। আমর৷ সেই সুযোগে পেছন দিয়ে ভেতরে ঢুকবো।

দুদলে ভাগ হয়ে গেল তারা। শহীদ আর কামাল অনেকটা ঘুরে জঙ্গল আর আবর্জনা পেরিয়ে বাড়িটার পিছনে গিয়ে উপস্থিত হলো। পাঁচিলটা বেশ উচু। একজনের পক্ষে খালি হাতে বেয়ে ওঠা অসম্ভব। কামালের কাঁধে পা দিয়ে দাড়িয়ে দেয়ালের উপরটা ধরলো শহীদ, তারপর এক হাত দিয়ে কামালকে টেনে তুললো। দু জনে হাত দিয়ে দেয়াল ধরে ঝুলে রয়েছে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে দেখে শহীদ লোকটা ঘুরেই চলছে অনবরত। এক জায়গায় গিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার আধ মিনিট পর সম্পূর্ণ ছাতটা ঘুরে আসে। কিন্তু এই আধ মিনিটের মধ্যে দেয়াল টপকে দৌড়ে গিয়ে বাড়ির গা ঘেষে দাঁড়ানো অসম্ভব-মাঝের জায়গাটা বেশ বড়, ধরা পড়ে যাবে।



হাতটা ব্যথা হয়ে আসে কামালের। এবার আধ মিনিট পার হয়ে গেল, লোকটা আসছে না। প্রায় মিনিট দুয়েক পর এসে ঘুরে গেল। অমনি শহীদ দেয়াল টপকে ওপাশে লাফিয়ে পড়লো। কামালও এলো। শহীদ বললো, আমার পেছন পেছন দৌড় দে। প্ৰাণপণে ছুটলো দুজন বাড়িটার দিকে। বেশ বড় কম্পাউন্ড। মাঠ পার হয়ে বাড়িটার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ওরা। ফিসফিস করে শহীদ বললো, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। ব্যাটা এখন পুলিসদের ওপর খুব কড়া নজর রাখছে।

বাড়িটার মধ্যে কোনও প্রাণের সাড়া পাওয়া গেল না। অতি সন্তৰ্পণে নিঝুম বাড়ির ছাতের সিড়ির কাছে এসে দাড়ালো ওরা। সিড়িটা অন্ধকার পা টিপে টিপে শহীদ আর কামাল উঠে এলো সিড়ি বেয়ে। লোকটাকে দেখা গেল। ব্যস্ত পদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাতের উপর বাক্স হাতে। বাড়ির সামনের দিকটায় তার নজর বেশি। সামনের দিকে ঝুঁকে মাঝে মাঝে কি যেন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখছে ও। এই যে, চারদিকটা একবার ঘুরে এসে আবার ঝুঁকলো লোকটা। কামালের গা টিপে তাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে ইশারা করে শহীদ বাঘের মতো দ্রুত অথচ নিঃশব্দ গতিতে এগিয়ে গেল তার দিকে। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেই ঘুরেছে অমনি প্রচও এক মুষ্টাঘাত এসে পড়লো তার নাকের উপর। চারদিকে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো লোকটা। এবার একটু পিছিয়ে এসে স্টেপ নিয়ে একটা পুরো নক-আউট পাঞ্চ কাষালো শহীদ। ঘুরে পড়ে গেল লোকটা। ঠক করে যন্ত্রটা তার হাত থেকে ছিটকে নিচে পড়লো।



কামাল এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। একটা রুমাল লোকটার মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়ে সিল্কের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো তাকে কামাল। লোকটাকে সেইখানেই ফেলে রেখে কামাল আর শহীদ সাবধানে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো আবার।

দশটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। কুয়াশা কলম বন্ধ করে ঘড়ির দিকে চাইলো। হেকমত আলীর পাশে এসে দাঁড়ালো সে। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার গবেষণার ফল জানতে পারা যাবে। দীর্ঘ পনেরো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম। হয় আজ সাফল্য, নয় পরাজয়।

ঠিক দশটার সময়ে যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলো সে। অল্প অল্প করে বেশ খানিকটা ব্রান্ডি খাওয়ালো হেকমত আলীকে। তারপর বাঁধন খুলে দিলো তার। খুব সাবধানে উঠিয়ে বসালো তাকে। বললো, একটু কেশে খানিকটা কফ বের করুন তো হেকমত সাহেব। হ্যাঁ, এই কাচটার ওপর ফেলুন। এবার শুয়ে পড়ুন।

মাইক্রোস্কোপের কাছে সরে এলো কুয়াশা। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠলো, ইউরেকা, ইউরেকা! Successful!



আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো কুয়াশার মুখ। হেকমত আলীর দিকে ফিরে বললো, আপনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হেকমত সাহেব। এখনও আপনার লাংসে কিছু ক্ষত আছে, তবে সেটা সেরে যেতে পনেরো দিনের বেশি লাগবে না। আপনি বাড়ি ফিরে আপনার সব পুরনো জামা কাপড় পুড়িয়ে ফেলবেন। নইলে আবার ধরবার সম্ভাবনা আছে। একটু ভালো diet খেলে তিনমাসের মধ্যে আপনি আপনার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন। আপনার শরীরে এখন একটিও জীবিত যক্ষ্মা বীজাণু নেই, হেকমত সাহেব।

ফ্যালফ্যাল করে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন হেকমত সাহেব। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, মেরে ফেলো আমাকে। আর কষ্ট দিও না! মেরে ফেলো, তোমার পায়ে পড়ি মেরে ফেলে!

চমকে ফিরে তাকায় কুয়াশা। হেকমত আলীর চোখ দুটো রক্ত জবার মতো লাল টকটকে। পাগল হয়ে গিয়েছেন হেকমত আলী। চিৎকার করে বললেন, পানি, পানি দাও।

কয়েক চামচ ব্রান্ডি ঢেলে দিলো কুয়াশা তাঁর গলায়।

মেরে, কোলো। উঃ! তোমার পায়ে পড়ি মেরে ফেলো। আবার চিৎকার।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে কুয়াশা। টেবিলের উপর কনুই রেখে কপালের দু ধার টিপে ধরে সে। আর অপেক্ষা করা চলে না। শহীদ খান এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে ঢুকবার চেষ্টায় ক্ষ্যাপা কুকুর হয়ে গেছে। এক্ষুণি এখান থেকে সরে পড়তে হবে।

উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। কিন্তু একর, এতো বড় পাষন্ড, তার চোখে জল। হেকমত সাহেবের দিকে ফিরে কুয়াশা বললো, আমি চললাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমি নিজ হাতে আপনার এই দশা করলাম। উঃ! তার গলা ভেঙে আসে।

যাওয়ার আগে আমাকে খুন করে যাও! আর পারি না! পায়ে পড়ি তোমার!

দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকে কুয়াশা। তারপর ঘুরে দাঁড়ায়।

ঠিক এমনি সময় শহীদ আর কামাল এসে ঢুকলো ঘরে। দুজনের হাতেই উদ্যত রিভলবার।

মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও, কুয়াশা।

চমকে উঠলো কুয়াশা। তারপর বিদ্যুৎগতিতে টেবিলের উপর থেকে যন্ত্রটা তুলে নিলো হাতে। সাথে সাথেই গর্জে উঠলো শহীদের রিভলবার। ক্যামেরার চোখের মতো একটা চোখ ছিলো যন্ত্ৰটার। সেই কাঁচের চোখটা গুড়ো করে দিয়ে শহীদের অব্যর্থ বুলেট প্রবেশ করলে৷ যন্ত্রটার মধ্যে। ঝন ঝন করে একটা শব্দ হলো। বিকল হয়ে গেল যন্ত্র।

করলে কি শহীদ। আমার সারা জীবনের সাধনা নষ্ট করে দিলে। বিকৃত হয়ে গেল কুয়াশার মুখ। গভীর বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো তাতে। আরো কি যেন বলতে চেষ্টা করলো কুয়াশা; তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কেবল ঠোঁট নড়লো, কথা বেরোলো না।

এমন সময় পিছন থেকে বড় কণ্ঠে আওয়াজ এলো, হ্যান্ডস আপ।

ঘুরে দাঁড়ালো ওরা দুজন। সামনে কেউ নেই। আবার আওয়াজ এলো, হাত থেকে রিভলব্যর ফেলে দাও, নইলে খুলি ফুটো করে দেবো। আমি দরজার আড়ালেই রয়েছি!

দুজনেই ফেলে দিলো রিভলবার।

এবার মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও।

শহীদ, কামাল মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়ালো। একমিনিট, দুইমিনিট। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কেউ আসে না আর সামনে। কোনো কথাও নেই। ওরা পরস্পরের দিকে ফিরে তাকালো। শহীদ পিছন ফিরে দেখলো কুয়াশা অদৃশ্য হয়ে গেছে পিছন। থেকে। মূহুর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল শহীদের কাছে। মাটি থেকে রিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়ে শহীদ ছুটে গেল পাশের ঘরে। সেখানেও নেই কুয়াশা। ঘরের এক কোণে একটা গৰ্ত মতো জায়গা পাওয়া গেল। সিড়ি নেমে গেছে নিচে। একটা চৌকোণা পাথর চাপা ছিলো গর্তের মুখে। পাথরটা এখন সরানো।

নেমে গোল শহীদ সিড়ি বেয়ে। কামালও নামলো পিছন পিছন। ঘন অন্ধকার ভিতরে। নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না। সাবধানে যতোটা সম্ভব তাড়াতাড়ি নেমে শহীদ হোঁচট খেলো। সিড়ি শেষ হয়ে গেছে সে টের পায়নি। সামলে নিয়ে চারদিকে হাত বাড়ালো শহীদ। একটা দিক ছাড়া সব দিকই বন্ধ। এগিয়ে গেল শহীদ খোলা পথটা ধরে। পুরো পাঁচ মিনিট চলার পর পথটা শেষ হলো। কয়েক ধাপ সিড়ি দিয়ে উঠে একটা পাথর ঠেকলো হাতে। বেশ ভারি পাথর। প্রাণপণ শক্তিতে ঠেলা দিয়ে পাথরটা সরিয়ে ফেললো শহীদ। লাফিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। খোলা আকাশ, তারা মিটমিট কাছে। সামনে গড়াই নদী। একটা লঞ্চ দাড়িয়ে আছে ঘাট থেকে বেশ অনেকটা দূরে।



হঠাৎ শহীদের খুব কাছে থেকে শব্দ এলো, শহীদ খান, আমার সারা জীবনের সাধনা তুমি নষ্ট করে দিয়েছো। প্রস্তুত থেকো, আমি নির্মম প্রতিশোধ নেবো।

কামাল চারদিকে তাকাচ্ছে, কে কথা বলে? শহীদ বললো, কাকে খুজছিস কামাল। কুয়াশা এখন লঞ্চের মধ্যে।

বলতে না বলতেই মৃদু গর্জন করে লঞ্চ ষ্টার্চ দিলো। চলতে আরম্ভ করেছে লঞ্চটা। কামাল রিভলবার ছুঁড়লো লঞ্চ লক্ষ্য করে। দূর থেকে একটা অট্টহাসি শোনা গেল। অনেকক্ষণ ধরে সে হাসি নদীর পারের বাড়িগুলোতে প্রতিধ্বনি তুললো। শহীদ একটা দীর্থ নিঃশ্বাস ফেললো। পাশ থেকে কে বলে উঠলো, পালিয়ে গেল, না?

শহীদ চেয়ে দেখলো দারোগা সাহেব কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

আবার তারা তিনজন সুড়ঙ্গ দিয়ে ফিরে এলো কুয়াশার পরিত্যক্ত বাড়িতে। হেকমত আলী তেমনি শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন, তারপর হঠাৎ চমকে ওঠেন আতঙ্কিত হয়ে। চিৎকার করে ওঠেন, মেরে ফেলো! পায়ে পড়ি, মেরে ফেলো!

ঘরের মধ্যে কুয়াশার যন্ত্রটা পড়ে আছে। আরও কয়েকটা অদ্ভুত আকারের যন্ত্র টেবিলের উপর রাখা। টেবিলের উপর একটা প্যাডের দিকে শহীদের নজর গেল। একটা চিঠি লেখা রয়েছে। সম্বোধনটা পড়ে আশ্চর্য হোলো শহীদ, তাকেই লেখা। দারোগা সাহেবের দিকে তাকিয়ে শহীদ বললো, তিনতলার উপর একজন লোক হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। তাকে হাজতে পাঠিয়ে দিন। আর হেকমত আলী সাহেবকে তার বাড়িতে পৌছাবার একটা ব্যবস্থা করে দিন।

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে শহীদঃ

শহীদ খান,

তুমি যখন এ ঘরে উপস্থিত হবে তখন আমি বহুদূরে। আজ আমার শেষ পরীক্ষা। যদি সফল হই, পৃথিবী আমায় পুজো করবে। আর যদি সফল হতে না পারি, চিরকালের জন্যে আমার প্রতিভার পরিসমাপ্তি ঘটবে। সে ক্ষেত্রেও আমায় চলে যেতে হবে এখান থেকে। কারণ, তুমি আমায় চিনে ফেলেছো।

তোমায় আমি বন্ধু হিসেবে নিয়েছিলাম-সত্যিই তুমি তার যোগ্য। পৃথিবীতে কেউ যদি আমায় বুঝে থাকে, সে হচ্ছো তুমি। কার্ল ব্র্যান্ডে নবাৰ্গও আমাকে বোঝেননি। আমি তারই হাতে মানুষ, তিনিই আমাকে সবরকম শিক্ষা দীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু যেদিন তিনি আমায় জোর করে জার্মানীতে আটকে রেখে আমার গবেষণার ফল ভোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন, সেদিন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে আমার কিছুমাত্র বাধেনি। আমি বাঙালী। আমি বাঙলা থেকে আমার পরীক্ষার ফল পৃথিবীকে জানাবো। জার্মানী থেকে পালিয়ে আসতে হয় আমাকে পুলিসের ভয়ে। কিন্তু এ দেশে এসে কি পেলাম? পুলিসের তাড়া। কিন্তু তোমার কাছ থেকেও কি আমি সহানুভূতি আশা করতে পারি না? পারি না একটু মায়া, একটু ভালবাসার দাবি করতে?

আরও আগে থেকে বলি, নইলে ভালো করে বুঝতে পারবে না।

আমার academic qualification-এর কথা শুনলে আশ্চর্য হবে। আমি ম্যাট্রিক পাস। ছোটকাল থেকেই আমার সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক ছিলো। একটা সারোদ কিনেছিলাম। বাবাই কিনে দিয়েছিলেন। পড়াশোনাতে আমি খুবই ভালো ছিলাম।

কিন্তু ম্যাটিক পাস করবার পর আমি সরোদ নিয়েই অতিরিক্ত মেতে উঠি। ফলে। I..S.C.-তে ফেল করলাম। বাবা খুবই আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই বলেননি আমায়। আমি তখন অন্য ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত। একটা তারে টোকা দিলে একটা সুর বাজে, তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। আমার চিন্তা হলো, মিলিয়ে যায় কোথায়? জানতাম সেকেন্ডে কতবার থেকে কতবার কাঁপলে তারের শব্দ মানুষ শুনতে পায়। কিন্তু তার বেশি বা কম যদি কাপে? তাহলে? শোনা না গেলেও তো সে কাঁপন বাতাসে থেকে যায়। জানবার খুব আগ্ৰহ হলো। ঠিক এই সময়ে একটা বই পেয়ে গেলাম আলট্রা সোনিক্স সম্বন্ধে। সেটা পড়ে আগ্রহ আরও বাড়লো। আরও কতগুলো কিনলাম। এদিকে বাবা ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছেন। শেষে যখন পড়াশোনা একেবারে ছেড়ে দিয়ে আলাট্রা সোনিক্সের experiment শুরু করলাম, তখন একদিন ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাবা। আমি বাবার দোষ দিই না। তিনি অনেক সহ্য করেছিলেন।



আমি কলকাতায় চলে গেলাম। খেয়ে না খেয়ে দুবছর সেখানে কাটালাম। কাল ব্যান্ডে নবার্গ নামে একজন জার্মান বৈজ্ঞানিক তখন কলকাতায় এসেছিলেন। ইউনিভারসিটির আমন্ত্রণে। আমি সোজা তার কাছে গিয়ে বললাম, আপনি বৈজ্ঞানিক, আপনি আমার ব্যকুলতা বুঝবেন, আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আমি তাকে impress করতে পেরেছিলাম। তিনি আমাকে জার্মানীতে নিয়ে গেলেন সাথে করে। সেখানে পনেরো বছর কাটিয়েছি আমি।

সতেরো আঠারো বছর বয়সে আমি বাঙলা ছেড়েছিলাম। এই কুষ্টিয়ায় আমার বাড়ি। ছোট দুবছরের বোনটিকে খুব মনে পড়তো। ওকে দেখবার জন্য সুদূর জার্মানীতে বসে অনেক ছটফট করেছি। কতো বিনিদ্র রাত আমার কেটেছে মায়ের জন্যে বুক ভাসিয়ে কেঁদে।

যখন দেশে ফিরে এলাম তথন সকলের আগে ছুটে এলাম কুষ্টিয়ায়। মা অনেকদিন হলো মারা গেছেন। বাবা যক্ষ্মা হয়ে বিছানা ধরেছেন। ছোটো বোনটা কতবড় হয়েছে। সে ম্যাটিক পাস করে তখন মাষ্টারি করছে স্কুলে, আর সেই সঙ্গে কলেজেও ভর্তি হয়েছে। তুমি ঠিকই সন্দেহ করছো শহীদ, হেকমত আলী সাহেবই আমার বাবা, মহুয়া আমার ছোটো বোন। আমিই শখ করে তার নাম রেখেছিলাম মহুয়া। আমার নাম মনসুর আলী।

আমি নিজের পরিচয় দিলাম না। ঢাকায় গিয়ে আমি আমার গবেষণার জন্যে সরকারের সাহায্য চাইলাম। আমার কোনও qualification নেই। কেউ আমার কথা কানেই তুললো না। অনেক তদবির করলাম, ইউনিভারসিটিতে চেষ্টা করলাম, কোথাও কিছু হলো না। কয়েকজন ধনী লোকের কাছে গেলাম। তারা হাঁকিয়ে দিলো। তখন আমি কপর্দকশূন্য। সেই সময়ই আমি প্রথম ডাকাতি করি। তোমার হয়তো খেয়াল থাকতে পারে, আজ থেকে তিন বৎসর আগে ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক হাজার টাকা চুরি গিয়েছিল। কি ভাবে চুরি হলো তা অনেক চেষ্টা করেও পুলিসের Intelligence Branch ধরতে পারেনি। সে টাকা আমিই চুরি করি। তারপর সে টাকা দিয়ে এখানে established হই ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে ব্যবসায় উন্নতি করে টাকা পয়সা করে। নিজের গবেষণা চালিয়ে যাবো। কিন্তু তা আর হলো না। অনেক চেষ্টা করেও আমি মহুয়াকে অর্থ সাহায্য করতে পারিনি। বড় একরোখা মেয়ে। এদিকে চিকিৎসার অভাবে বাবার শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। আমি দেরি করলে হয়তো তিনি আর বাঁচবেন না। তাই আমাকে যতো শিগগির সব টাকা জোগাড় করতে হয়, experiment করবার জন্যে মানুষ খুন করতে হয়।

আজ আমার সামনে একটা খাটের উপর শুয়ে আছেন আমার বাবা। আর কিছুক্ষণ পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। তারপর আমি চলে যাবো অনেক দূরে। কোনদিন বাবার কাছে নিজের পরিচয় দেবো না-তার যে ছেলেকে তিনি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন একদিন, সে মরে গেছে, কোনও দিন আর ফিরে আসবে না। আমার বুঝি অভিমান নেই?

কিন্তু বলিহারী তোমার বুদ্ধিকে। তোমায় এক ফোঁটাও সন্দেহ করতে পারিনি আমি। অথচ তুমি দিনের পর দিন আমার কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছো। এখন মনে পড়ছে, আমি নিঃসন্দেহে তোমাকে কতকগুলো ঠিকানা লিখে দিয়েছি। উহ, কি বোকা আমি। আমি প্রত্যেকদিন টেলিগ্রাম পেয়েছি আমার লোক মারফত গোয়ালন্দ থেকে, they are here.

আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। যে কদিন তুমি আমাকে তোমার বন্ধুত্ব উপহার দিয়েছিলে তার জন্যে তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমায় বন্ধু বলে স্বীকার করেছি বলেই অনাথ চক্রবর্তী আমার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখেছি। তুমিন না হয়ে যদি আর কেউ হতো, তার কাছে অনেক টাকা পয়সা নিয়ে নায়েব এসেছে জানতে পারলে আমি সে টাকা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করতে কসুর করতাম না। আমি তোমায় চিরকাল বন্ধু বলেই জানবো। আমার পেছনে অনেক ঘুরেও শেষ পর্যন্ত আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না তুমি।



বিদায় বন্ধু! আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না কোনও দিন। আমার বাজনাও আর শুনতে পাবে না তুমি। আমার ছন্নছাড়া জীবনে একজনই পেয়েছিলাম, তাকেও বাধ্য হয়ে হারাতে হচ্ছে আজ।

ফোঁস করে একটা দীর্ষনিঃশ্বাস ফেললো শহীদ। দারোগা সাহেব এসে ঢুকলেন ঘরে। বললেন, ব্যাটাকে হাতড়া পরিয়ে দুজন পুলিশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম হাজতে। এখন ঘোড়াগাড়ির জন্যে লোক পাঠিয়েছি। গাড়ি এলে হেকমত সাহেবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি।

আমরাও যাবে। আপনার সাথে। পথে একজন ভালো ডাক্তারকে তুলে নিয়ে যেতে হবে।

Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: কুয়াশা - ০১
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ১২. ফুটফুটে অন্ধকার ঘরটা
পরবর্তী :
Next post:১৪. হেকমত আলীর বাসা »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *

COMMENT


NAME *


EMAIL *


WEBSITE




Search for:

0 Response to "কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১৩"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন