কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১১
কামালকে টেলিগ্রাম করলো শহীদ। সেদিনই বিকেলে কামাল আর গফুর এসে পৌঁছলো। সুন্দর মেকআপ হয়েছে কামালের। গফুরকেও চেনা যায় না।
সন্ধ্যের দিকে রফিকুল ইসলাম এসে বসলো শহীদের ঘরে। অনেক রকম কথা হচ্ছিলো। গফুরের প্রকান্ড কাঠামোর দিকে চেয়ে সে বললো, বাঃ, অদ্ভুত জিনিস পেয়েছো তো, অনাথ বাবু। তোমার নাম কি হে?
আজ্ঞে আমার নাম পেল্লয় বাগদী।
কিল মেরে কটা মানুষের মাথা একসাথে ভাঙতে পারো?
ও গোটা দুই পাঠান বা সাহেবকে চড় মেরে ঘুরিয়ে ফেলে দিতে পারে। শহীদ হেসে বললো।
গফুর সিধে রফিকের দিকে চেয়ে বললো, আজ্ঞে, দাদামণিকেও কিছু কম মনে করবেন না। আমার চাইতে তিনগুণ বেশি শক্তি আছে ওনার গায়ে। অনেকবার সে পরীক্ষা হয়ে গেছে।
শহীদ দেখলো, গফুর স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যাচ্ছে। দাদামণির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ও এখনি বেফাঁস কথা বলে বসবে। রফিককে এড়িয়ে কয়েকবার চোখ টিপলো সে। গফুর দেখেই না। সে বলেই চলেছে, ঢাকায় বছর খানেক আগে একবার আমাদের বাড়ির সামনে কয়েকজন গুন্ডা ধরেছিল দাদামণিকে। সেই যে, প্ৰথম প্রথম দাদামণির মাথায়…
বাথরুম থেকে আওয়াজ এলো, প্রলয়। আমার তোয়ালেটা দে তো বাক্স থেকে বের করে, ফেলে এসেছি।
গফুর সচেতন হয়ে গেল। সে বাক্স খুঁজে বললো, নেই তো বাবু আপনার তোয়ালে বাক্সের মধ্যে।
ওহ-হো। এই তো কাপড়ের তলায় ছিলো। লাগবে না যা, পাওয়া গেছে।
গফুর নিচে গেল। রফিকুল ইসলাম বললো, ঢাকায় তোমার বাড়ি আছে বুঝি?
ছিলো। এখন ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। আমি এখন রায়পুরাতেই থাকি।
হঠাৎ রফিকুল ইসলাম উঠে দাঁড়ালো। আমাকে এখুনি যেতে হচ্ছে, অনাথ বাবু। আমার মনেই ছিলো না একখানে এনগেজমেন্ট আছে। তুমি এগারোটার সময় অবিনাশ বাবুকে নিয়ে আমার বাসায় এসো।
ত্ৰস্ত পদে বেরিয়ে গেল রফিকুল ইসলাম। এইমাত্র কোথা থেকে যেন একটা টেলিগ্রাম এসেছে। সেটা পড়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভুলে টেবিলের উপর ফেলে গেছে সে। সেটা খুলে একবার চোখ বুলালো শহীদ, তারপর আবার যথাস্থানে বন্ধ করে রেখে দিলো।
কিছুক্ষণ পরই রফিকুল ইসলাম ফিরে এলো। টেলিগ্রামটা ভুলে রেখে গেছিলাম, বলে সেটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
খাওয়া দাওয়ার পর কামাল বললো, কোনো সূত্র পেলি এতদিনে?
কিছু কিছু পেয়েছি, কিন্তু আরও বড় প্রমাণ চাই।
কাকে তোর সন্দেহ হয়?
সে পরে শুনিস। এখন তোকে আমি একটা কাজ দেবো। চটপট তৈরি হয়ে নে।
কি কাজ?
আমার পেছনে একজন লোক ঘুরছে কদিন ধরে। তার ওপর তোর নজর রাখতে হবে। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখ, ঐ যে লোকটা দেখা যাচ্ছে পান কিনছে মোড়ের দোকানে, ভালো করে চিনে রাখ ওকে। আজ রাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আমাকে বাইরে যেতে হবে তার জন্যে। আমার পেছনে এ লোকটা লেগে থাকবে। তুই শুধু খেয়াল রাখবি যেন লোকটা আমাকে বেকায়দায় না পায়। দরকার হলে রিভলবার ছুড়বি। মেরে ফেলিস নে আবার। জখম করবি শুধু।
কি ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, শহীদ। কোথায় দুর্ঘটনা ঘটবে? এই লোকটাই বা কে?
বোঝাবার সময় নেই! এখন নয়টা বাজে। আর সময় নেই। আমি তৈরি হয়ে নিই, তুইও একটা কিছু পরে নে। আমার পাঁচ মিনিট পর তুইও বেরিয়ে যাবি হোটেল থেকে। খবরদার, লোকটাকে চোখের আড়াল করবি না। তাহলে তুই আর মজমপুর চিনবি না। আমি খুব বিপদে পড়তে পারি।
ঠিক হ্যায়। আমি ঠিক নজর রাখবো। ঐ ব্যাটা ঘোতকাকে আর আমার চোখ এড়াতে হচ্ছে না।
কালো স্যুট পরা একজন দীর্ঘাকৃতি যুবক আদর্শ হিন্দ হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল। ম্যানেজার একবার তাকালো তারপর নিজের কাজে মন দিলো। লোকটা বোধহয় জমিদার বাবুর কাছে এসেছিল।
তার মিনিট পাঁচেক পর একজন অতি বৃদ্ধ ভিক লাঠি হাতে, একটা ছেড়া থলে গলায় ঝুলিয়ে হোটেলের পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। শীতে তার হাত পা কাঁপছে। অতি অপরিষ্কার ছেড়া কাপড় দিয়ে যতোটা সম্ভব শীত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছে।
থানাপাড়ার রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে যুবক। রাস্তার একপাশে সারি সারি বন্ধ দোকান। এদিকটা এমনিতেই নির্জন তার উপর আজ রবিবার-সারাদিনই দোকান-পাট বন্ধ। পথিকের জুতোর শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দোকানগুলোর বদ্ধ দরজায়। লাইট পোস্টের নিচে তার ছায়াটা ছোট হয়ে আসে, আবার বড় হতে হতে মিলিয়ে যায়। আরেকটা পোস্টের কাছে এসে ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে বরাবর হেঁটে এসে দাঁড়ালো সে একটা মোড়ের কাছে। ডান দিকে একটা কাঁচা রাস্তা। মেইন রোডটা বা দিকে ঘুরে রেল লাইন পেরিয়ে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। কোনও দিকে না তাকিয়ে এই কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো সে। এক হাঁটু ধুলো রাস্তায়। বরাবর কিছুদর এগিয়ে একটা একতলা বাড়ির ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো যুবক। একেবারে নির্জন এলাকায় বাড়িটা, আশে পাশে আর কোনো বাড়ি নেই। আর সিকি মাইলটাক পুবে এগোলেই গড়াই নদী। বাড়িটার উল্টো দিকে রাখার ওপাশে বেশ বড় একটা মাঠ। তারও দক্ষিণে কয়েকটা বাড়ির পিছন দিক। মাঠটা জঙ্গল হয়ে আছে আগাছায়। ছোট ছোট ঝোপ। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছও আছে। রাস্তাটার ডান ধারে লাইন করা কতকগুলো জিগে গাছ। লোকটা ঢুকে পড়লো জঙ্গলে। বাড়িটার উপর ভালো নজর রাখা যায় এমন একটা জায়গা বেছে নিয়ে সে স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
বাড়িটার দক্ষিণ দিকে একটা জানালা খোলা। একটা ক্ষীণ আলো জ্বলছে ঘরের ভিতর। আশে পাশে কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। ঘড়িটার দিকে চাইলো যুবক! দশটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। পকেট থেকে কি একটা শাখের মতো জিনিস বের করে মুখে লাগিয়ে ফু দিলো। ঘেউ করে একটা শব্দ হলো জোরে। ঠিক যেন অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ডাক। সাথে সাথেই ঘরের ভিতরের আলোটা নিভে গেল।
চুপ করে দাড়িয়ে আছে যুবক। মাঝে মাঝে মুখের সামনে হাত নাড়ছে। বড্ডো বেশি মশা।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা একটা শক্ত জিনিসের স্পর্শ পেলো সে। চমকে ঘুরে দাঁড়ায় যুবক। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। শুধু একটা ছায়ামূর্তি তার সামনে দাড়িয়ে আছে বোঝা যায়।
হ্যান্ডস আপ। চাপা অথচ গভীর গলায় আওয়াজ এলো।
যুবক দুহাত উপরে তুলে দাঁড়ায়।
বাছাধন। ভেবেছো ছদ্মবেশ পরে খুব ফাকি দিলে। এইবার তোমার সব জারিজুরি বের করবো। যুবকের পকেটে হাত দিয়ে রিভলবারটা বের করতে গেল আগন্তুক। মুখে তার ক্রুর হাসি।
হঠাৎ কি হতে কি হয়ে গেল। খট করে একটা শব্দ হলো। আগন্তুকের হাত থেকে ছিটকে রিভলবার মাটিতে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে লোকটা। আরেকটা শব্দ, খট। কিছু-মাত্র শব্দ না করে লোকটা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এবার যুবক কথা বললো, ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলি, কামাল! জব্বর মার মেরেছিস, এখন নে, রুমালটা ব্যাটার মুখে পুরে দে, আর এইটা দিয়ে ভালো করে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেল। আমি মোটেই টের পাইনি ব্যাটা আমার এতো কাছে ছিলো।
একটা রুমাল আর একগাছা সিল্কের দড়ি বের করে দিলো শহীদ। তারপর মাটি থেকে রিভলবারটা তুলে নিলো।
ঠিক সোয়া দশটার সময় দূর থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শোনা গেল। কামাল বললো, গলির মুখে এসে শব্দটা থেমে গেল বলে মনে হচ্ছে।
হা। থামবে। সময় উপস্থিত। ফিসফিস করে বলে শহীদ। রিভলবার হাতে করে দাঁড়া। ওকি কাপছিস কেন? ভয় লাগছে?
গায়ে কাপড় নেই, শীত করছে।
শহীদ তার গায়ের কোটটা খুলে কামালের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো। স্নেহের সুরে বললো, গাধা। ভিক্ষার থলেতে একটা আলোয়ান আনতে পারিসনি?
কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। তার মুখ চেপে ধরে শহীদ ফিসফিস করে বলে, চুপ! ঐ দেখ আসছে। ওরই নাম কুয়াশা! সামান্যতম আওয়াজ হলেই ও টের পেয়ে যাবে। একদম চুপ।
কাছে এলে গুলি করবো?
খবরদার। আমার আদেশ ছাড়া কিছু করবি না৷
একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। পায়ের তালে তালে কেবল একটা হাত দুলছে। আরেকটা হাত স্থির। শহীদ একটু অবাক হয়। না, আরেকটা হাতও আছে – সে হাতে একটা বাক্স মতো কি ঝোলানো।
সন্তৰ্পণে এগিয়ে আসছে কুয়াশা। কামালের বুকটা হিম হয়ে আসে। এই লোকটাই অবলীলাক্রমে মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে। এই যে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা, সে একজন খুনী, ফাঁসির আসামী।
ওদের ঝোপের থেকে রাস্তা হাত পাঁচেক দূরে। ঠিক ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। চারদিকে সন্তৰ্পণে একবার চাইলো। তারপর বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো কুয়াশা। বাক্সটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। তারপর জানালার একটা শিকের ওপর ধরলো বাক্সটা।
শহীদ পকেট থেকে কি একটা বের করে তাতে ফুঁ দিলো৷ দুবার। ঘেউ। ঘেউ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দুবার ডেকে উঠলো একটা কুকুর। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকের প্রচন্ড এক আওয়াজ। ধ্বনি প্ৰতিধ্বনি তুলে অনেকক্ষণ ধরে শব্দটা এ বাড়ি ওবাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগলো। স্যাৎ করে সরে গেল কুয়াশা জানালার ধার থেকে। একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দ্রুতগতিতে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। উদভ্রান্তের মতো কামাল রিভলবার তুললো। শহীদ চেপে ধরলো তার হাত। কয়েক সেকেন্ড একটা গাছের এপারে বাড়িটা থেকে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কুয়াশা। তারপর দৌড় দিলো বড় রাস্তার দিকে। একটু পরেই আবার ঘোড়াগাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দটা।
আবার শিঙাটা নিয়ে শহীদ তিনবার কুকুরের ডাক ডাকলো। ঘরের ভিতর একটা আলো দেখা গেল একটু পরেই। দরজা খুলে হ্যারিকেন হাতে একটা মেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। আপনি কোথায়, শহীদ ভাই? মেয়েটি জোরে ডাকে।
এই তো এখানে। হ্যারিকেনটা নিয়ে এই দিকে আসুন।
আলোটা এগিয়ে এলো। মেয়েটি ব্যগ্ৰ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, সে এসেছিল শহীদ ভাই? ওখানে কি পড়ে রয়েছে? আরে অনেক রক্ত যে? মেয়েটির গলা কেঁপে ওঠে।
লোকটা তখনও জ্ঞান ফিরে পায়নি। শহীদ ওকে অনায়াসে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। তারপর মেয়েটিকে বললো, আপনি আলো ধরুন সামনে। হ্যাঁ, এখন চলুন বাসার দিকে। এর জ্ঞান আগে ফিরিয়ে আনি, তারপর একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। আপনার বাবা সুস্থ আছেন তো?
হ্যা। বাবা মোটেও ভয় পাননি। বাব্বা, আমার কী ভয় যে করছিল।
বৈঠকখানার দরজা খুলে দিলো মেয়েটি। ঘরের মধ্যেখানে লোকটাকে শুইয়ে দিয়ে শহীদ বললো, আপনি একটা ন্যাড়া ভিজিয়ে আনুন তো শিগগির।
মেয়েটি বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে। ফিরে এসে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে লোকটার মুখের রক্ত মুছে দিলো। মাথার একটা জায়গা বেশ অনেকখানি কেটে গেছে, রক্ত বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। লোকটার মুখে চোখে জল ছিটাতে লাগলো সে।
কামাল আর শহীদ বাইরে এসে জানালার সামনে দাঁড়ালো। এইখানেই দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা। একটা শিকের নিচের দিকটা গলে গেছে। কয়েক ফোটা গলা লোহা পড়ে রয়েছে। কামাল শহীদের দিকে চাইলো, শহীদও কামালের দিকে চাইলো। কেউ কোনও কথা বললো না। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে কামাল হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, তোর জন্যে শহীদ, কেবল তোর জন্যে আজ কুয়াশা পালিয়ে যেতে পারলো। নইলে আমি ওর বুকের মধ্যে বুলেট ঢুকিয়ে টের পাইয়ে দিতাম খুন করবার মজা।
উত্তেজিত হোস না কামাল। মাথা ঠান্ডা কর। ওকে খুন করলে পুলিস তোকে ধরতো খুনের দায়ে। কিছুতেই তুই প্রমাণ করতে পারতিস না যে ও-ই কুয়াশা। ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই।
অন্তত ওকে আহত করে বন্দী করা তো অসম্ভব ছিলো না।
অসম্ভবই ছিলো, কামাল। ওর হাতে একটা বাক্স দেখেছিস না? ওটা আমাদের দিকে ধরে একটা বোতাম টিপলে আমাদের ভবের লীলা সাঙ্গ হতে এক সেকেন্ডও লাগতো না। ওকে আহত করবার অর্থ নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনা।
শহীদের কথায় বিশেষ সন্তুষ্ট হলো না কামাল। অন্য দিকে মুখ ফুরিয়ে বসে রইলো। হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়াতে শহীদ মেয়েটির কাছে কাগজ কলম চাইলো। খশ খশ করে কি কি সব লিখলো। তারপর ভাঁজ করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললো, আমাদের খুব জরুরী কাজ আছে। আমরা এখুনি চলে যাচ্ছি। লোকটার জ্ঞান হলে এ চিঠিটা ওকে দেবেন, আর এই যে ওর রিভলবার, এটাও। বলে শহীদ চিঠি আর রিভলবার দিলো মেয়েটির হাতে।
কামালের মুখটা হাঁ হয়ে গেছিলো। সামলে নিয়ে অতি কষ্টে রাগ চেপে মেয়েটির দিকে চেয়ে বললো, আর আমাদের ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি, ওকে বলবেন যদি কিছু মনে না করে তাহলে যেন দয়া করে গিয়ে কামাল আহমেদ আর শহীদ খানের বুকে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে আসে।
এর এই চাপা রাগ দেখে শহীদ হেসে ফেললো। আরও রেগে গিয়ে কামাল বললো, তোমার তামাশা আমি বুঝি না শহীদ। লোকটাকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেয়ার কি অর্থ হতে পারে? তুমি তো মরতে বসেছিলে ওর হাতে। এখন আবার অতো দয়া কেন?
রেগে গেলে সে শহীদকে তুমি করে বলে। শহীদ ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, আয় কামাল, পথে যেতে যেতে সব বুঝিয়ে দেবো। এখন আয়, দেরি করিস না, আমাদের জরুরী কাজ আছে।
হোটেলে ফিরে এলো ওরা নিরাপদেই। গফুর মাটিতে একটা বিছানা পেতে কাঁথা জড়িয়ে বসে পুঁথি পড়ছিল, হরিদাস বসে শুনছিল। অপরিচিত লোক দেখে হরিদাস একটু আশ্চর্য হলো। এতো রাতে আবার কোনো ভদ্ৰলোক কারও সাথে দেখা করতে আসে? নিচে চলে গেল ও।
বেশ বদল করে ওরা রফিকুল ইসলামের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। খাটের উপর বসলো শহীদ, কামাল বসলো একটা চেয়ারে। যন্ত্রে ইতিমধ্যেই সুর মিলিয়ে রেখেছে রফিক। রাত প্রায় দেড়টায় আসর ভাঙলো। কামাল ঝিম হয়ে রয়েছে। দরবারী বাজালো আজ রফিক। এগিয়ে এসে কামাল হঠাৎ রফিকুল ইসলামের পায়ের ধুলো নিলো। সসব্যস্ত হয়ে উঠলো রফিকুল ইসলাম। লজ্জা পেয়ে বললো, ও কি করেন। আপনি আমার চাইতে বয়সে অনেক বড়। ছি, ছি!
যখন কামাল উঠে দাঁড়ালো তখন তার চোখে জল। রফিকের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর মৃদুস্বরে বললো, গুণী। শিল্পী! আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি নাও।
কামালকে জড়িয়ে ধরলো রফিক। বললো, আমায় যে বোঝে সে আমার চাইতে কোনো দিক দিয়ে ছোটো নয় আবিনাশ বাবু। আপনারা আমার বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছেন দুজন মিলে। আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি যে কেউ আমার গান বুঝবে, অনুভব করবে। সঙ্গীত বুঝতে হলে চাই উদার মন। আপনাকে কি করে যে আমার ভালোবাসা জানাবো বুঝতেই পারছি না, অবিনাশ বাবু।
কামাল রফিকের বাহুপাশ থেকে ছুটে বললো, কাল আবার আসতে পারবো তো?
নিশ্চয়ই। কাল এগারোটার সময় আসবেন। আজ কিন্তু আপনারা বেশ দেরি করে এসেছিলেন।
কাল ঠিক সময়ে আমরা পৌঁছোবো, রফিক সাহেব। শহীদ বলে। আর এখন আমরা আসি।
চাকরটাকে কফি আনতে বলেছিলাম। ও বোধহয় আমাদের disturb হবে ভেবে এতক্ষণ আনেনি। একটু বসো, কফি খেয়ে যাও।
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রফিকের মিশমিশে কালো চাকরটা এসে ঢুকলো ঘরে। একটা ট্রেতে করে ককি আর কয়েকটা বিস্কিট এনেছে।
একটা বোতল খুলে কিছু raw gin গলায় ঢেলে দিলো রফিক। বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ রফিককে। একমাথা কোঁকড়ানো চুল। অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটোতে আজ যেন একটা স্বপ্নের আবেশ। বড় ভালো লাগছে ওকে। একটা গাঢ় চকোলেট রঙের আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে বসেছে ও। মিষ্টি হেসে বললো, জানো, আজ আমার জন্মদিন।
তাই নাকি? আগে বলোনি কেন? শহীদ বললো।
কেন, কিছু প্রেজেন্ট করতে বুঝি? আমি প্রেজেন্টেশন নিতে ভালবাসি না।
ভালো কথা।
আচ্ছা, আপনি বিটোফেনের সুর ভালবাসেন, অবিনাশ বাবু?
হাঁ। অবশ্য ভালো বুঝি না। কিন্তু মন্দ লাগে না।
কাল এসো, তোমাদের কয়েকটা জার্মান সুর বাজিয়ে শোনাবো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সরোদেই, আর কিছু আমি জানি না বাজাতে। শহীদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে হেসে বলে রফিকুল ইসলাম।
আপনি ওদেশের সঙ্গীতও জানেন? জিজ্ঞেস করে কামাল।
এই সামান্য কিছু। আমি পনেরো বছর জার্মানীতে ছিলাম।
জার্মানীতে? বিস্মিত হয় শহীদ, কামাল।
হ্যা। সে অনেক কথা। আরেকদিন শুনবেন। আজ না, কেমন? কয়েক ঢোক মদ খায় রফিকুল ইসলাম।
পরদিন সকালে শহীদ আর কামাল চা খাচ্ছে, এমন সময় চিঠি হাতে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে। বললো, আপা চিঠিটা দিলেন, বুললেন খুব জরুরী।
চিঠিটা পড়ে শহীদের ভ্রু কুঁচকে গেল। কামালের হাতে দিলো চিঠিটা। কালকের সেই মেয়েটির লেখা। লিখেছেঃ
শহীদ ভাই,
কাল মাঝরাত থেকে বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাত তিনটের দিকে গরম জল নিয়ে দেখি গিয়ে বাবা বিছানায় নেই-জানালার সব কটা গরাদ বাঁকানো এখনো পুলিসে খবর দিইনি। বড় বিপদে পড়েছি। আপনি শিগগির একবার আসুন।
ইতি—মহুয়া
এক মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো। রিক্সায় কামাল জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটা হিন্দু নাকি রে!
না। মুসলমান। ওর বাবার নাম হেকমত আলী। কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। বছর পাঁচেক থাইসিসে ভুগছেন-বিছানায় পড়ে আছেন। মেয়েটি বি.এ. পড়ছে। গার্লস স্কুলে মাস্টারি করে আর পড়ে। সংসারও সেই চালায়।
রিক্সা এসে থামলো বাড়িটার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওরা এগিয়ে গেল। বাইরে থেকেই দেখা গেল জানালার সব কটা গরাদ বাকানো। মহুয়া বেরিয়ে এলো। মুখটা শুকিয়ে গেছে সারারাত্রির চিন্তায়। কিন্তু বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। কামাল লক্ষ্য করলো মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দরী। বয়স আঠারো কুড়ির মধ্যে। চমৎকার গড়ন, রঙটা উজ্জ্বল গৌর। মুখ দেখে কেউ বুঝবে না ঐ মেয়ে কঠোর সংগ্রাম করছে বেঁচে থাকবার জন্যে। টানাটানা চোখগুলো বড় গভীর। সমস্ত মুখটায় একটা নিস্পাপ সারল্য আছে।
আপনি বাবাকে ফিরিয়ে এনে দেন, শহীদ ভাই।
আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আজ এখানে আমার আসবার কোনও প্রয়োজন ছিলো না, কেবল আপনাকে বলতে এলাম, ভয় পাবেন না, আজই আপনার বাবাকে ফিরিয়ে এনে দেবো। এখন যাই, একটু থানায় যেতে হবে।
আমি আসবো সঙ্গে?
না, দরকার হবে না। পুলিস আসবে না। আপনার এখানে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করুন। বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোবেন না আজ।
শহীদ আর কামাল বেরিয়ে গেল। শহীদের কপালে চিন্তার রেখা। থানার দিকে এগোলো ওরা।
Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: কুয়াশা - ০১
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ১০. কামালের চিঠি এলো
পরবর্তী :
Next post:১২. ফুটফুটে অন্ধকার ঘরটা »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *
COMMENT
NAME *
EMAIL *
WEBSITE
Search for:
0 Response to "কুয়াশা - ১ | পর্ব - ১১"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন