Ads Golpo.Best Kobita.Best

search

কপোট্রনিক ভালবাসা | মুহম্মদ জাফর ইকবাল


আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি রিসার্চ সেন্টারের করিডোরে আমাকে গুলি করেছিল। স্পষ্টতই সে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু যে-কারণেই হোক, আমি মরি নিী এবং কে আমাকে গুলি করেছিল সেটা এখন পর্যন্ত বাইরের কেউই জানে না। আমার বাম ফুসফুসেটা ফুটো হয়ে গিয়েছিল এবং এজন্যে আমাকে পুরো তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এই সুদীর্ঘ তিন মাস আমি যেসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছি, আমার গবেষণার সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি মানুষের ইচ্ছা, আকাঙক্ষা, বেঁচে থাকার প্রেরণা, আনন্দল ও যন্ত্রণার যৌক্তিকতা নিয়ে ভেবেছি। হাসপাতালের নিঃসঙ্গ পরিবেশ বা আমার অসুস্থ অবস্থার জন্যই হোক, আমি পরিপূর্ণভাৰে হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি আঁত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করছিলাম। ঠিক এই সময়ে আমাের সেই বন্ধুটি আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। সে ভীষণ শীর্ণ হয়ে পড়েছিল, তার চোখের কোণে কালি, মুখে অপরাধবোধের ছাপ।

তুমি পুলিশকে আমার নাম বলতে পারতে—সে ঠিক এই কথাটি দিয়ে শুরু করেছিল—বল নি দেখে। ধন্যবাদ। তবে যদি ভেবে থাক এটা তোমার মহত্ত্ব এবং মহত্ত্ব দিয়ে তুমি আমার উপর প্রভুত্ব করবে, তা হলে খুব ভুল করছি।



আমি তার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, তুমি কী জন্যে আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে সেটা না জানলে হয়তো তোমাকে আমি ঘৃণা করতাম না। কিন্তু এখন তোমাকে আমি ঘৃণা করি।

সে আমার এই কথাটায় বিচলিত হয়ে পড়েছিল। আমার কাছ থেকে বিদায় নেবার পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, হয় সে, নাহয় আমি বেঁচে থাকব। একজন অন্যজনকে ঘৃণা করতে করতে পাশাপাশি বেঁচে থাকতে পারে না। পরের দিনই আমি খবর পেয়েছিলাম আমার বন্ধুটি গুলি করে তার মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছে। আমি জানতাম তার অনুভূতি চড়া সুরে বাঁধা, কিন্তু এতটা ধারণা করি নি।



হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকের চাকরিটি ছেড়ে দিলাম। আমার বয়স তখন মাত্র চরিশ বছর, আর সে-বছর থেকেই পায়োনের সাব-স্ট্রাকচারের মডেলটি আমার নামে পরিচিত হতে লাগল। এই মডেলটি আমার চিন্তাপ্রসূত এবং আমার মৃত বন্ধুটির এটির প্রতি মোহ জন্মেছিল।

সবরকম আকর্ষণ থেকে ছাড়া পাওয়া আমার পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হয়েছিল। এর জন্য আমাকে যথেষ্ট নির্মম ও বিরূপ সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই বাইরের জগতের জন্য আকর্ষণ জাগাতে পারছিলাম না। আমি নিজের ভিতরে একটি আর ভাবনার জগৎ গড়ে তুলেছিলাম, আমার সেখানে ড়ুবে থাকতেই ভালো লাগছিল।



যে-মেয়েটি আমাকে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করত, ক্ৰমে ক্রমে সেও আমার অসহ্য হয়ে উঠল। তাকে বিদায় করার পর আমার দৈনন্দিন কাজে নানারকম বিঘ্ন ঘটতে লাগল। আমার সারা দিনের রুটিন ছিল খুব সাদাসিধে। আমি অনেক বোলা পর্যন্ত ঘুমোতাম। ঘুম থেকে উঠে। সারা দিন ছবি আঁকতাম। রাত্ৰিবেলা আমি দর্শন ও মধ্যযুগীয় চিরায়ত সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতাম। আমি কারো সাথে দেখা করতাম না। সপ্তাহে এক দিন লেটার-বক্স থেকে চিঠিগুলি এনে ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। ফোনটার তার কেটে দিয়েছিলাম বহু আগেই। আমার এই সহজ জীবনযাত্রায় শুধু দুবেলার খাবার ও একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ঝামেলাটুকুও অসহনীয় হয়ে উঠল। এজন্যে একজন সাহায্যকারী রাখতেই হয়। আমি গৃহকৰ্মে পারদর্শী একটা রবোট কিনব কি না ভাবছিলাম। কিন্তু আমার ঘরে ভাবলেশহীন একটা যন্ত্ৰদানব ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভোরে আমার কফি তৈরি করে দিচ্ছে, কাপড় ইন্ত্রি করছে—এটা ভাবতেই আমার মন বিরূপ হয়ে উঠল। আমার ইচ্ছে করছিল একটা সংবেদনশীল রবোটের সাহচর্য পেতে। কিন্তু পৃথিবীতে অনুভূতিসম্পন্ন রবোট এখনো তৈরি হয় নি। আমি প্রায় হঠাৎ করে ঠিক করলাম, একটা অনুভূতিসম্পন্ন রবোট আমি নিজেই তৈরি করব–সম্পূৰ্ণ আমার মনোমতো করে।

এই সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করার পর আমার জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে গেল। আমার বেশিরভাগ মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকত রবোটের নক্সা ও খুঁটিনাটি বিষয়ে। পরিশ্রম করতে শুরু করার পর একটা মেয়েকে কাজে সাহায্য করতে রাখার বিরক্তিটাও তত বেশি মনে হল না।



সাধারণ রবোট তৈরি এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। রবোটের মস্তিষ্ক-যেটাকে সাধারণভাবে কপোট্রন বলা হয়ে থাকে, সেটা যে-কোনো ফার্ম থেকেই অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু আমার রবোটটির জন্যে ঠিক কী ধরনের কপোট্রন প্রয়োজন বুঝতে পারছিলাম না। বি-এফ-২ ধরনের কপোট্রন গৃহস্থালি কাজের জন্যে ব্যবহার করা হয়। কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে যেসব রবোট ব্যবহার করা হয়, তাদের কপোট্রন এল. ২. বি.টাইপের। আমাদের বিদ্যালয়ের বিভাটনটির ভার দেয়া ছিল এল. এ, এফ, টাইপের কপোট্রনযুক্ত রবোটকে।

আমি যে রবোটটি তৈরি করতে যাচ্ছি, সেটাতে এগুলোর কোনোটিই খাটবে না, কারণ এ সবগুলিই বিভিন্ন যান্ত্রিক বিষয়ে অভিজ্ঞ। সংবেদনশীলতা বা যেটাকে আমরা অনুভূতি বলে থাকি, সেটা এগুলোর কোনোটিতেই নেই। সংগীতে অবশ্যি গাণিতিক রবোটের বি. কে. ২১ কিপেটিন ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু সেসব রবোট গাণিতিক বিশ্লেষণ করে সুর সৃষ্টি করলেও সুরকে অনুভব করতে পারে না। কারণ অনুভূতি বলে যে-মানবিক প্রক্রিয়াটি আছে, সেটা এখন পর্যন্ত মানুষের একচেটিয়া। আমি এমন একটি রবোট সৃষ্টি করতে চাইছি, যেটা গান শুনতে ভালবাসবে, কবিতা পড়বে, হাসবে, এমন কি দুঃখ পেলে কাঁদবে। আনন্দ, বেদনা, ঈৰ্ষা বা রাগ-এ সব কয়টি মানবিক অনুভূতি যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি করা যায় কি না। আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

ফার্মগুলোর ক্যাটালগে আমার মনোমতো কপোট্রন পাওয়া গেল না। একটি ফার্ম অবশ্যি ঘোষণা করেছে, হাসতে পারবে এমন একটি কপোট্রন তারা শীঘ্রই প্রদর্শন করবে। তাদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম, শীঘ্রই বলতে তারা আরও চার বছর পরে বোঝাচ্ছে। তারা দুঃখ করে লিখেছে, অনুভূতিসম্পন্ন রবোট তৈরির পরিকল্পনা সরকার অনুমোদন করতে চাইছে না, কারণ এটার কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই।

আমি একটি দেশীয় ফার্মকে অর্ডার দিয়ে একটি সাধারণ বি-১ ধরনের কপোট্রন তৈরি করলাম। এটির নিউকেপটিভ সেলের সংখ্যা সাধারণ কপোট্রনের চার গুণ, মানুষের নিউরোন সেলের প্রায় অর্ধেকসংখ্যক। তবে এটির কোনোরকম যান্ত্রিক দক্ষতা নেই। আমাকে কপোট্রনটি হস্তান্তরের সময় ডিরেক্টর ভদ্রলোক এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলে

কপোট্রনটিকে বিভিন্ন অংশের সাথে সংযুক্ত করে রবোটের আকৃতি দিতে আমাকে প্রায় রবোটের মতোই খাটতে হল। পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকায় আমার সময়ও লাগল। অনেক বেশি। সৌভাগ্যক্রমে আমি আমার সব বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। আমাকে এই ছেলেমানুষি কাজে এরকম সময় নষ্ট করতে দেখলে তাদের বিরক্তির অবধি থাকত না।



রবোটটি শেষ করার পর তার চেহারা দেখে আমার তাক লেগে গেল। রবোট তৈরির প্রথম যুগে যেরকম অতিকায় রবোট তৈরি করা হত, এটা হয়েছে অনেকটা সেরকম। অতিকায় মাথা, ঠিক মানুষের চোখের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দুটি সবুজাভ চোখ—যদিও সব রবোটেই একটিমাত্ৰ চোখ থাকে, আমি দুটি না দিয়ে পারি নি। মুখের জায়গায় স্পিকার। নাক ছাড়া খারাপ লাগছিল দেখে একটা কৃত্রিম গ্রিক ধাঁচের নাক স্কু দিয়ে এটে দিয়েছি। চতুষ্কোণ শরীরের দু পাশে ঝুলে থাকা হাত, হাতে মোটা মোটা ধাতব আঙুল। দুটো থামের মতো শক্ত পা, হাঁটুর জায়গায় জটিল যান্ত্রিক জোড়। পায়ের পাতা বিরাট বড়, গোলাকৃতির, অনেক জায়গা জুড়ে আছে ভারসাম্য রক্ষার গেন্যে। আমি রং করে পায়ের আঙুল, বুকের পেশি, ঠোঁট, কান, চোখের ভুরু, চুল—এসব এঁকে দিলাম। বলতে লজ্জা নেই, তাতে রবোটটির চেহারার উন্নতি না হয়ে কাগতাড়ুয়াদের মতো দেখাতে লাগল।

বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার পর রবোটটি চোখ পিটপিট করে ঘুরে দাঁড়াল। তার লুকের ভিতর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জনধ্বনি ভেসে আসছিল। সবুজাভ চোখে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ খেলা করতে লাগল। আমি বললাম, তোমার নাম প্রমিথিউস।

কথাটি আমি ভেবে বলি নি, কিন্তু রবোটটি মাথা ঝুঁকিয়ে সেটি মেনে নেবার পর আমার আর কিছু করার ছিল না।



প্রমিথিউসকে আমার দৈনন্দিন কাজের সাথে পরিচিত করে তুলছিলাম। সে সকালে নাস্তা তৈরি করে দিত, ঘর পরিষ্কার করত এবং মাঝে মাঝে কাপড় ইন্ত্রি করে দিত। বলতে দ্বিধা নেই, তার আচার-আচরণ ছিল পুরোপুরি গবেটের মতো। তার সৌন্দর্যবোধের কোনো বালাই ছিল না। ফুলপ্যান্ট ইন্ত্রি করুত্ব আড়াআড়িভাবে। একদিন স্বাধীনভাবে ঘর পরিষ্কার করতে দেয়ায় দেয়ালে টাঙানো দুটো অয়েলপেইনটিং ফেলে দিয়েছিল।

যখন প্রমিথিউসের সাথে যথেষ্টভাবে পরিচিত হয়ে উঠলাম, তখন একদিন তার বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নিতে বসলাম। সাধারণ জ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রশ্ন করে তাকে জীবনানন্দ দাশ নামক জনৈক প্রাচীন বাঙালি কবির লাইন পড়ে শোনালাম,

এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে—
জানি না সে এইখানে গুয়ে আছে কিনা–

তারপর জিজ্ঞেস করলাম, এই লাইন দুটি সম্পর্কে তোমার কী মত?

চিন্তায় অসঙ্গত কোনো মানুষের উক্তি।

তাকে গঁগার আঁকা একটি পলিনেশিয়ান মেয়ের ছবি দেখালে সে অনেকক্ষণ ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে বলল, বিকৃত শারীরিক গঠনের একটি মেয়ের ছবিতে দুর্বোধ্য কারণে সব কয়টি রং অনিয়মিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

গঁগার শিল্পকীর্তির এ-ধরনের মূল্য বিচারে আমার পক্ষে হাসি চেপে রাখা মুশকিল হল। উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কী করছিলাম?

আপনি হাসছিলেন।

হাসি কি?

এক ধরনের অর্থহীন শারীরিক প্রক্রিয়া।

তুমি হাস তো।

সে আমার হাসিকে অনুকরণ করে যান্ত্রিক শব্দ করল।



প্রমিথিউসকে নিয়ে হতাশ হবার পিছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। কিন্তু আমি হতাশ হই নি। তার ভিতরে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করার জন্যে আমি কিছু নতুন সংস্কার করব ঠিক করলাম। সৌন্দর্য নিয়ে আমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হল। সৌন্দর্যের গাণিতিক বিশ্লেষণ। আমাকে এ ব্যাপারে বাস্তব সাহায্য করল।

প্রমিথিউসের ভিতর সৌন্দর্যচেতনা জাগাতে হলে তার ভিতরে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যার জন্যে সে যখনই সুন্দর কিছুর সম্মুখীন হবে, তখনই তার ভালো লগতে শুরু করবে। সোজাসুজি তাকে ভালো লাগার অনুভূতি দেয়া সম্ভব নয়—তার কষ্ট কমিয়ে দেয়ার অনুভূতি দেয়া যেতে পারে। কষ্ট কমানোর আগে তাকে সবসময়ের জন্যে খানিকটা কষ্ট দিয়ে রাখতে হবে। কপোট্রনের নিউকোপটিভ সেলে একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ দিয়ে রাখলে কপোট্রন তার সবরকম যান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে চেষ্টা করবে: বৈদ্যুতিক চাপের অসমতাকে দূর করতে। এই অবস্থাটাকে কপোট্রনের কষ্ট বলা যায়। যখনই বৈদ্যুতিক চাপের অসমতাকে কমানো যাবে, তখনই কষ্ট কমে গিয়ে একটা ভালো লাগার পরোক্ষ অনুভূতি সৃষ্টি হবে। কপোট্রনের সেলগুলির সামনে একটা পরিবর্তনশীল বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সৃষ্টি করে সহজেই এটা করা যায়। কিন্তু প্রকৃত ঝামেলার সৃষ্টি হবে সুন্দর কিছু দেখা, শোনা বা অনুভব করার সাথে সাথে এই বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাব পরিবর্তন করার মাঝে। এ জন্যে কপোট্রনের সেলগুলিকে অনেকগুলি ভাগে ভাগ করতে হল। বাইরের জগতের যে-কোনো প্রভাব সেগুলোতে আলাদা আলাদাভাবে ছড়িয়ে পড়ত। সৌন্দর্যের গাণিতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী সেগুলি সুন্দরের আওতাভুক্ত হলেই কপোট্রনের কৃষ্ট কমতে থাকত—ঘুরিয়ে বলা যায়, কপোট্রনের ভালো লাগা শুরু হত। সৌন্দর্যের তীব্রতা অনুযায়ী সে-ভালো লাগাও কম বা বেশি হতে পারে।





প্রমিথিউসের এই সংস্কার করতে গিয়ে আমাকে পশুর মতো পরিশ্রম করতে হল। দীর্ঘ সময় প্রমিথিউসকে অচল রেখে তার কপোট্রনে অস্ত্ৰ চালাতে হয়েছে। কপোট্রনের এধরনের জটিল কাজ করে সূক্ষ্ম কাজে পারদশী আর-২১ ধরনের রবোট। দু মােস দশ দিন পর আমি যখন প্রমিথিউসের সংস্কার শেষ করলাম, তখন আমার কন্টাক্ট লেন্সের পাওয়ার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, ওজন কমেছে চার পাউন্ড। অবিশ্যি এ-কথা স্বীকার না করলেই নয়, ওজন মাত্র চার পাউন্ড কমার পিছনে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব বুলার। বুলা আমার কাজকর্মে সাহায্য করার নূতন মেয়েটি। প্রমিথিউসের সৌন্দর্যচেতনা সৃষ্টির সময় একজন সাহায্যকারীর জন্যে কোম্পানিকে লিখলে তারা এই মেয়েটিকে পাঠায়। আর দশটা মেয়ের মতো সেও ছুটির সময় চাকরি করে অর্থোপার্জন করছে। সামনের জুলাই মাসে সে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পরীক্ষা দেবে।

প্রমিথিউসকে আবার জীবনদান করার সময় ঘরটাকে যথাসম্ভব ফাঁকা করে দিলাম। টিপে আমাকে অপেক্ষা করে থাকতে হল—সূতন আবিষ্কৃত রূডোন মিনিট পাঁচেক পরেই প্রমিথিউসের চোখে বৈদ্যুতিক ফুলিঙ্গ খেলা করতে লাগল। প্রমিথিউস তার একটা হাত অল্প উপরে তুলে দ্বিধান্বিতভাবে আবার নামিয়ে ফেলল।

কেমন আছ? আমার প্রশ্নের উত্তর সে সাথে সাথে দিল না। আগে কখনও এরকম করে নি। একটু পরে বলল, ভালো।

আমার ভুলও হতে পারে, কিন্তু মনে হল ওর কথায় যেন আবেগের ছোঁয়া লেগেছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ভিতরে কোনো পরিবর্তন টের পাচ্ছ?

না তো! কেন?

উত্তর না দিয়ে আমি হাত বাড়িয়ে টেপ রেকর্ডারটি চালিয়ে দিলাম। এহুদি মেনুহিনের বেহালার করুণ সুরে মুহূর্তে সারা ঘর ভরে উঠল। প্রমিথিউস শক্‌ খাওয়ার মতো চমকে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি টেপ রেকর্ডারটি বন্ধ করে দিতেই আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, স্যার, বন্ধ করবেন না।

কেন? এটা শুনতে কেমন লাগছে?

প্রমিথিউস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বলল, এটা বিভিন্ন কম্পনের শব্দতরঙ্গের পারস্পরিক সুষম উপস্থাপন। কিন্তু এটা শুনলে আমার ভিতরে এমন একটা বিচিত্র প্রক্রিয়া হতে থাকে যে, ইচ্ছে হয় আরো শুনি, আরো শুনি।

আমি বুঝতে পারলাম, প্রমিথিউসকে তার নূতন অবস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। বললাম, প্রমিথিউস, এহুদি মেনুহিনের বেহালার সুর শুনে তোমার ভিতরে যে-দুর্বোধ্য শারীরিক প্রক্রিয়া হচ্ছিল, সেটির নাম ভালো লাগা। পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র রবোট, যে ভালো লাগা খারাপ লাগার অনুভূতি বুঝতে পারে।

প্রমিথিউস দুপা সরে এল। যান্ত্ৰিক মুখে একাগ্রতা, নিষ্ঠা ইত্যাদি ছাপ ফোটানোর পরবর্তী পরিকল্পনা আমার মাথায় উঁকি দিয়ে গেল।

আস্তে আস্তে ভূমি আরো নূতন অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে।

কি রকম?

যেমন এই গোলাপ ফুলটি। আমি জানালা খুলে তাকে বাগানের সবচেয়ে সুন্দর গোলাপ ফুলটি দেখলাম।

স্যার। প্রমিথিউস চেঁচিয়ে উঠল, আমার ভালো লাগছে!

হ্যাঁ। সুন্দর জিনিস দেখলেই তোমার ভালো লাগবে, তবে তা চেঁচিয়ে বলার দরকার নেই। আমি তাকে ফুলটি ছিঁড়ে আনতে বললাম। সে ফুলটিকে ছিঁড়ে এনে চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। আমি তার হাত থেকে ফুলটি নিলাম, নিয়ে হঠাৎ কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেললাম!

প্রমিথিউসের ভিতর থেকে আর্তনাদের মতো একটা যান্ত্রিক শব্দ বের হল। আবার আমি বললাম, তোমার এখন আমার প্রতি যে-অনুভূতি হচ্ছে–সেটার নাম রাগ। রাগ বেশি হলে তোমার কপোট্রন তোমার উপর যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে।

প্রমিথিউস কোনো কথা বলল না। স্পষ্টতই ও রাগ হয়েছে।

অর্থহীন কাজ দেখলে রাগ হয়। গোলাপ ফুলটা তোমার ভালো লেগেছে, আমি শুধু ওটা ছিঁড়ে ফেলেছি, তাই তোমার রাগ হয়েছে।

প্রমিথিউস অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, আমার গোলাপ ফুল খুব ভালো লাগে।



খুব ভালো লাগার আর একটি নাম আছে। সেটা হচ্ছে ভালবাসা।

প্রমিথিউস বিড়বিড় করে বলল, আমি গোলাপ ফুল ভালবাসি।

ঠিক সেই সময় কুলা তার একরাশ কালো চুলকে পিছনে সরিয়ে দরজা খুলে ঘরে এসে ঢুকল। বলল, স্যার, আপনার খাবার সময় হয়েছে।

আসছি।

না, এক্ষুনি চলুন, দেরি হলে জুড়িয়ে যাবে। মেয়েটি ছেলেমানুষ, আমাকে না নিয়ে কিছুতেই যাবে না। আপত্তি করব, তার উপায় নেই। কীভাবে জানি আমি তার অনেকটুকু প্ৰভুত্ব মেনে নিয়েছি।

আমি প্রমিথিউসকে বসিয়ে রেখে মেয়েটির পিছে পিছে খাবার ঘরে গেলাম। যাওয়ার সময় শুনলাম প্রমিথিউস বিড়বিড় করে বলছে, আমি এই মেয়েটিকে ভালবাসি।



প্রমিথিউস কিছুদিনেই একজন বিশুদ্ধ সংস্কৃতিবান রবোটে পরিণত হল। তাঁর প্রিয় কবি জাঁ ককতো। মূল ফরাসি ভাষা থেকে প্রমিথিউসের অনুবাদ করা কবিতাগুলি ধারাবাহিকভাবে একটি সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। আমি তাকে মৌলিক রচনা করার উৎসাহ দিয়েছি। বর্তমানে সে কপোট্রনিক সংশয়গুচ্ছ নাম দিয়ে একটি কবিতার বই লিখিছে।

কিছুদিনের ভিতরে সে উপন্যাস পড়ায় ঝুঁকল। আমি তাকে গোর্কি শেষ করে কাফকায় ড়ুবে যেতে দেখলাম। হেমিংওয়ে, সাত্রে, কামু পড়ে যেতে লাগল দ্রুত।

বুলা পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। প্রমিথিউস আজকাল বুলার দায়িত্ব পালন করছে। স্পষ্টতই প্রমিথিউস খাবার টেবিলে বুলার মতোই আরেকটু মাংস নিতে পীড়াপীড়ি করে, কিন্তু তবুও বুলার অভাবটা আমার সহজে পূরণ হতে চাইল না। মেয়েটি সুন্দরী ছিল, বুদ্ধিমতী ছিল এবং আমার জন্যে প্রকৃত অর্থে মমতাও ছিল। বুলা চলে যাওয়ার পরপরই আমি বুঝতে পারলাম, আমি বুলাকে ভালবেসেছিলাম। আমার নিজস্ব ধ্যান-ধারণার মানবিক এই সমস্ত উচ্ছাসগুলির বিশেষ কোনো মূল্য নেই। কিন্তু যতই বুলার কথা ভূলতে চাইলাম, তত মস্তিষ্কের কোথাও অসম বৈদ্যুতিক আবেশ হতে থাকল। কাজেই যেদিন বুলা প্রমিথিউসের তত্ত্বাবধানে আমার জীবনযাত্রা কেমন চলছে দেখতে এল, সেদিন আমার আন্নদের সীমা রইল না।

এই যে বুলা! আমি এই শুষ্ক কথা কয়টি দিয়ে অভ্যর্থনা করলেও কিছুক্ষণের ভিতরেই প্রকৃত বক্তব্যে চলে এলাম। বললাম, তুমি আমার কাছে না এলে আমিই তোমার কাছে যেতাম। অর্থাৎ আমি তোমাকে—আমাকে একটু কাশতেই হল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

বুলা প্রথমে বিক্ষিত হল, পরে লাল হয়ে মাথা নিচু করল। আমি একটু দ্বিধা করে বললাম, তোমার আপত্তি থাকলে জানাতে পার। আমি তো আর এমন কোনো মহৎ ব্যক্তি নই, তুমি তো জানই আমার অনেক দোষ-ত্রুটি।

বুলা সহজ হল খুব তাড়াতাড়ি। স্যার বলে সম্বোধন ও আপনি সম্পর্ক থেকে আমার ছোট্ট, প্রায় অজানা ডাকনামটি দিয়ে সম্বোধন করে তুমি সম্পর্ক এত সহজ করে নিল, যে, আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরো অবাক হলাম যখন বুলা জানাল তার কুমারীজীবনের স্বপ্নই হচ্ছে আমার এই ছোট্ট ডাকনামটি দিয়ে আমাকে তুমি বলে ডাকবে।

বুলা বিদায় নেবার পর আমার কোনো কাজেই মন বসল না। আমি প্রমিথিউসকে ডেকে পাঠালাম। প্রমিথিউস দু হাতে কিছু বই নিয়ে হাজির হল। কিছু হ্যাভলক এলিসের লেখা, কিছু ফ্রয়েডের লেখা।



আপনি বলেছিলেন, প্রমিথিউস একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, খুব বেশি ভালো লাগার নাম ভালবাসা। কিন্তু এখানে অন্য কথা লিখেছে। প্রমিথিউস হ্যাভলক এলিসের একটা বই আমার হাতে তুলে দিল। বলল, এখানে লিখেছে ছেলে ও মেয়ের ভিতরে জৈবিক কারণে যে আকর্ষণ হয়, তার নাম ভালবাসা।

আমি একটু মুশকিলে পড়ে গেলাম। প্রমিথিউসকে তৈরি করার সময় এসব সমস্যা মোটেও ভেবে দেখি নি। আমি বললাম, তোমায় ওভাবে বলেছিলাম, কারণ তুমি এ ছাড়া বুঝবে না। তুমি পৃথিবীর যে-কোনো রবোট থেকে উন্নত, তোমার সুভূতি আছে; কিন্তু তবুও তুমি সম্পূৰ্ণ নও। জীবজগতের একটা মূল অনুভূতি—যৌনচেতনা তোমার নেই।

কেন? প্রমিথিউস দুঃখ পেল। আপনি আমাকে ভালো লাগার, দুঃখ পাবার অনুভূতি দিয়েছেন, তবে এটি দিলেন না কেন?

আমি অল্প উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বললাম, কারণ আছে প্রমিথিউস। প্রাণীদের এ চেতনা আছে, কারণ বংশবৃদ্ধিতে এটা তাদের দরকার। কিন্তু তুমি এটা দিয়ে কী করবে? তুমি কখনোই একটা শিশু রবোট জন্ম দেয়ার জন্যে একটা মেয়ে রবোট পাবে না।

প্রমিথিউস চুপ করে থাকল। বইগুলি টেবিলে রেখে বলল, আপনি আমাকে এই অসম্পূৰ্ণ অনুভূতি না দিলেও পারতেন। ছেলে আর মেয়েরা এমন কতকগুলি আচরণ করে, তা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। এতদিনে বুঝতে পারলাম ছেলে আর মেয়ের ভালবাসা কী জিনিস, সেটা অনুভব করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোলাগা বুঝতে পারব, ভালবাসা বুঝতে পারব না।

প্রমিথিউসের জন্যে আমার মায়া হল। আট ফুট উঁচু যন্ত্রদানব সবুজ চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ অনুনয়ের স্বরে বলল, স্যার, আপনি আমায় যৌনচেতনা দিতে পারেন না? দিন না, মাত্র একটি দিনের জন্যে দিন। আমি দেখি ভালবাসা কি !

আমি রাজি হলাম না। প্রমিথিউস মাথা নিচু করে চলে গেল।



আমার আর বুলার বিয়ে হল নভেম্বরে। বিয়ের পরদিনই আমরা হানিমুনে বের হয়ে গেলাম। বাসার যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের ভার থাকল প্রমিথিউসের উপর। দৈব দুর্ঘটনায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ ঘটে প্রমিথিউসকে যেন অচল হয়ে থাকতে না হয়, সেজন্যে তার ভিতরে একটা ছোট পারমাণবিক ব্যাটারি সংযোজন করে গেলাম।

আমি আর বুলা ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়ালাম। কখনো পাহাড়ে, কখনো বনে, কখনো—বা সমুদ্রের বালুবেলায়। আমাদের মধু-চন্দ্ৰিমার দিনগুলি কেটে যেতে লাগল দ্রুত। বাসায় ফিরে যাবার তাগিদ কিছুতেই অনুভব করছিলাম না। মাঝে একদিন ফোনে প্রমিথিউসের সাথে কথা বলেছি। সে জানিয়েছে সব ভালোই চলছে।

কিছুদিন পর আমার হঠাৎ করে কোয়ার্কের সাব-স্ট্রাকচার নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে করতে লাগল। চৰ্বিশ ঘন্টার ভিতর আমার ইচ্ছাটা এমন অদম্য হয়ে উঠল যে, আমি প্রমিথিউসের কাছে একটা টেলিগ্রাম করে দিলাম ষ্টেশনে গাড়ি পাঠাবার জন্যে। বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে যে-চাকরিটি দিতে চাইছিল সেটা এখনো দিতে রাজি কি না জানতে চেয়ে আরেকটা টেলিগ্রাম করলাম। জাতীয় পুস্তকালয়ে দু। ডজন। বইয়ের জন্যে লিখে পাঠালাম। আমার আচরণে বুলা অবাক হল না, বরং ভারি খুশি হয়ে উঠল। গবেষণামূলক কোনো কাজে সত্যিকার আগ্রহ নিয়ে লেগে থাকা কোনো মেয়ে পছন্দ না করে পারে না। এতে স্বস্তি আছে, ছকে ফেলা নিশ্চিত জীবন, এমন কি খ্যাতির বাঁধা সড়কের ইঙ্গিতও আছে।

আমরা পরদিন বাসায় পৌঁছে গেলাম। বাসার সব ভার বুলার উপর দিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকের দায়িত্বটি নিয়ে নিলাম। একটু গুছিয়ে নিতে আমার মূল্যবান ছটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। আমি আবার পড়াশোনা ও গবেষণার কাজ শুরু করে দিলাম। একদিন রাত্রিকালে হঠাৎ নিঃশব্দে প্রমিথিউস এসে দাঁড়াল। পড়াশোনার সময় কেউ আমাকে বিরক্ত করলে আমি সহ্য করতে পারি না। ভুরু কুঁচকে বললাম, কি চাই?

কপোট্রনিক সেলে বিদ্যুৎচৌম্বকীয় আবেশের জন্যে যে রেসিড়ুয়াল ম্যাগনেটিজমের সৃষ্টি হয়, তার ভারসাম্য রক্ষার সমীকরণে জিটা-নটের মান কোথায় পাব?

আমি অবাক হয়ে প্রমিথিউসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকে বিজ্ঞানসংক্রান্ত একটি অক্ষরও আমি শেখাই নি। কিন্তু সে যে জিনিসটা জানতে চেয়েছে, তার জন্যে প্রথম শ্রেণীর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা জানা দরকার।

তুমি এসব শিখলে কোথায়?

আপনি যাওয়ার পর পড়াশোনা করেছি।

সাহিত্যাটাহিত্য ছেড়ে এসব ধরলে কেন?

প্রমিথিউস উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে থাকল। আমি তার সমস্যার সমাধান খুঁজে দিলাম। মনে মনে একটু খুশিও হলাম। একটু শিখিয়ে—পড়িয়ে নিলে আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

এবার আমি পড়াশোনায় অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুলার জন্যে সময় করে ঘুমোতে হত; খেতে হত; বাকি সময়টা আমি লাইব্রেরি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাটোতাম। সময় কেটে যেতে লাগল দ্রুত।

কয়দিন পর বুলা খাবার টেবিলে আমাকে বলল, তোমার প্রমিথিউসকে বিক্রি করে দাও।

কেন? আমি অবাক হলাম।

সে এ নিয়ে আমাকে তিনটি প্রেমপত্র লিখেছে।

শুনে হাসতে গিয়ে আমি বিষম খেলাম। আজকাল প্রমিথিউস নিশ্চয়ই খুব রোমান্টিক উপন্যাস পড়ছে। প্রেমপত্রগুলি দেখলাম, চমৎকার হাতের লেখা, ভারি সুন্দর চিঠি। প্রমিথিউসের লেখা না জানলে আমার ঈর্ষান্বিত হবার কারণ ছিল। আমি জানি প্রমিথিউস কোনোদিন কোনো মেয়েকে ভালবাসতে পারবে না, বড়জোর ওর ভালো লাগতে পারে। যাই হোক, ব্যাপারটা আমি ভুললাম না।

কয়দিন পর বুলা আবার আমায় অভিযোগ করল, প্রমিথিউস ওকে গোলাপ ফুলের তোড়া উপহার দিয়েছে, ওর হাত ধরে অনেকক্ষণ ভালবাসার কথা বলেছে। আমি খানিকটা অবাক হলাম। ওর ভিতরের সব যান্ত্রিক রহস্য আমার জানা। ও কেন যে ভালবাসার অভিনয় করে যাচ্ছে বুঝতে পারলাম না।



সে সপ্তাহে একটি নতুন পরীক্ষা চালান হয়েছিল। ফলাফল ভীষণ দুর্বোধ্য, খানিকটা রহস্যময়। আমি সেগুলি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলাম। রাত অনেক হয়ে গিয়েছে। আমাকে শোয়াতে না পেরে বুলা একাই শুতে গিয়েছে। ব্যাপারটা এত জটিল ও রহস্যময় যে আমার সময়ের অনুভূতি ছিল না। হঠাৎ দরজা খুলে বুলা ছুটতে ছুটতে এসে ঘরে ঢুকল। আতঙ্কে নীল হয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে বিকারগ্রস্তের মতো বলতে লাগল, প্রমিথিউস-প্রমিথিউস—।

কী হয়েছে? প্রমিথিউস কী হয়েছে?

আমায় মেরে ফেলতে চাইছে।

সে কী। আমি ভীষণ অবাক হলাম। প্রমিথিউসের খুঁটিনাটি, যান্ত্রিক জটিলতা, ভাবনা-চিন্তার পরিধি-সবই আমার জানা। প্রমিথিউস কখনও অন্যায় করতে পারবে না। বুলাকে প্রশ্ন করে বুঝতে পারলাম, প্রমিথিউস ওকে মেরে ফেলতে চাইছিল না, মানুষ যেমন করে একটি মেয়েমানুষকে আদর করে তেমনিভাবে আদর করতে চাইছিল। আমার একটু খটকা লাগল। বুলার প্রতি ওর মোহ জেগেছে অনেক দিন, সুন্দর কিছুর প্রতি আকর্ষণের জন্যে। কিন্তু ইদানীং ও যা করছে তা শুধু মানুষই করতে পারে, ওর মতো জৈব-চেতনাহীন যন্ত্ৰদানবের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। বুলার হাত ধরে আমি প্রমিথিউসকে খুঁজতে গেলাম। প্রমিথিউসের ঘরে বাতি নেভানো। ভিতরে ঢুকেই সুইচ টিপতেই প্রমিথিউস চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। ওর হাতে কলেজজীবনে কেনা আমার কোল্ট রিভলবারটি।

প্রমিথিউস। আমি আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম।

বলুন। সে খুব ঠাণ্ডা গলায় উত্তর করল।

আমি একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করতে চাইলাম, কিন্তু একটা প্রশ্নও করতে পারলাম না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল ও আমাকে গুলি করে বসবে, কিন্তু আমি জানি ও সেটা করতে পারে না।

তোমার হাতে রিভলবার কেন? আমি ওকে প্রশ্ন করলাম।

প্রমিথিউস এমন ভাব করল যে সে আমার কথা শুনতে পায় নি। আপন মনে বলল, আপনি কী জন্য এসেছেন। আমি জানি। কিন্তু সত্যিই বুলাকে আমি ভালবাসি।

এত সব ঘটনার পর প্রমিথিউসের মুখে এই উত্তর শুনে হঠাৎ করে রাগে আমার পিত্ত জ্বলে গেল। আমি ধমকে উঠলাম, ইডিয়ট কোথাকার! ভালবাসার তুমি কী বোবা?

আপনি ভুল করেছেন, স্যার। প্রমিথিউস এতটুকু উত্তেজিত হল না। বলল, আপনারা যখন এখানে ছিলেন না, তখন আমি কপোট্রন নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি আমার নিজের কপোট্রনে নিজে অপারেশান করেছি। আমি এখন মানুষের মতোই যৌন-চেতনাসম্পন্ন।

আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুলা আমার হাত ধরে শিউরে উঠল।

কিন্তু স্যার, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। প্রমিথিউস দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ করল। আমি ভুল করেছি, আমি অন্যায় করেছি। এখন আমি ভালবাসা কি, বুঝতে পারছি। একটা মেয়েকে কেন একটা ছেলে ভালবাসে, আমি অনুভব করতে পারি। প্রমিথিউস রিভলবারটি হাত বদল করল, ম্যাগাজিনটা লক্ষ্য করল তারপর বলল, আমি বুলাকে ভালবেসেছি, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি। আমাকে কেউ কোনাে দিন ভালবাসবে না। যত অনুভূতিই থাকুক, আমি কদাকার একটা যন্ত্র।

প্রমিথিউসের শেষ কথা কয়টি আর্তনাদের মতো শোনাল। আমি কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বললাম, তা তোমার হাতে রিভলবার কেন? দিয়ে দাও।

প্রমিথিউস আমার কথা না শোনার ভান করল। বলল, আমি বুঝতে পারছি— আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। এরকম শূন্য জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কী হবে? আমার কী মূল্য আছে? একটা তুচ্ছ যন্ত্র, কতকগুলো নিস্ফল অনুভূতি। প্রমিথিউস সবুজ চোখে বুলার দিকে তাকিয়ে রইল।

বুলা তোমার কাছে আমার আত্মাহুতির কোনো মূল্য নেই। তবু তুমি মনে রেখো একটা যন্ত্র তোমায় ভালবেসে আত্মহত্যা করেছে। প্রমিথিউস রিভলবারটি তার ডান চোখের সামনে ধরল। ঠিক এই জায়গা দিয়ে গুলি করলেই কপেটনের সেলবক্সের কন্ট্রোল টিউবটি গুঁড়ো হয়ে যাবে।

প্রমিথিউস-আমি বাধা দিতে চাইলাম।

স্যার! আপনার দেয়া অনুভূতিই আমার মরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। রবোটের আত্মা মরে গেলে কী হয়, বলতে পারেন স্যার?

পুরান দিনের রিভলবার। প্রচণ্ড শব্দ হল। ফটো টিউব গুড়িয়ে প্রমিথিউসের মাথা দুলে উঠল। কতকগুলো পরপর বিস্ফোরণ ঘটল। কালো ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ প্রমিথিউসের ফুটো চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল। মাথাটা একটু কান্ত করে এক চোখ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল প্রমিথিউস। তার সবুজ চোখ খুব ধীরে ধীরে শীতল নিষ্প্রভ হয়ে উঠল।

প্রমিথিউসের মৃত যান্ত্রিক দেহ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বুলার হাত ধরে বেরিয়ে এলাম। অনুভব করলাম, আমার হাতের ভিতর বুলার হাত থরথর করে কাঁপছে।

আমার বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, প্রিয়জন হারালে যেরকম হয়। আমার অবাক লাগিছিল, একটা যন্ত্রের জন্যে এরকম কষ্ট পাওয়া কি উচিত?

শেয়ার বা বুকমার্ক করে রাখুন

Facebook Twitter WhatsApp Email SMS
Categories: কপোট্রনিক সুখদুঃখ
পূর্ববর্তী :
Previous post:
পরবর্তী :
Next post:০২. কপোট্রনিক বিভ্ৰান্তি (এক) »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *

COMMENT


NAME *


EMAIL *


WEBSITE







Facebook

Twitter

0 Response to "কপোট্রনিক ভালবাসা | মুহম্মদ জাফর ইকবাল"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন