Ads Golpo.Best Kobita.Best

search

কুয়াশা - ১ | পর্ব - ৫


সকাল বেলা কামাল ঘুম থেকে উঠে দেখলো শহীদ আলোয়ান জড়িয়ে গুটিদুটি মেরে বসে আছে চেয়ারে। চোখ বন্ধ। গভীর ভাবে কি যেন ভাবছে। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। প্রকান্ড একটা হাই তুলে কামাল বললো, উঠলাম।

একটু চমকে উঠলো শহীদ। তারপর একটা খাম ওর দিকে ছুড়ে দিলো। বিছানার কাছে মাটিতে পড়লো খামটা। কুড়িয়ে নিয়ে খুলে ফেললো কামাল। ছোট এক টুকরো কাগজ। তাতে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখাঃ

শহীদ খান,

তুমি আমার পেছনে লাগতে এসো না। আমি জানি, যদি কেউ কখনও আমার কাজে বাধা দিতে পারে, সে হচ্ছো তুমি। পুলিস বা তাদের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ -এর সাধ্য নেই আমার কেশাগ্র স্পর্শ করে। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি আমাকে বাঁধা দিয়ো না। যে টাকা আমি চুরি করেছি সে সমস্তই মানব-কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হচ্ছে। আর যে সব মানুষ আমি চুরি করেছি, তাদের লাগিয়েছি আমার গবেষণার কাজে। আর কদিন পর যখন পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে যাবে আমার আবিষ্কার দেখে, যখন পৃথিবীর মানুষ প্রভূত উপকার পাবে সেই আবিষ্কার থেকে, তখন বুঝবে সামান্য কিছু টাকা আর কয়েকজন মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমি কতো বড় দান দিয়ে গেলাম পৃথিবীটাকে। ইতি–

কুয়াশা

কামাল চিঠিটা শেষ করে দেখলো শহীদ আবার চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। সে বললো, চিঠিটা পেলি কোথায়?

আমাদের মশারীর উপর।

কি ঠিক করলি?

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শহীদ বললো, একটা কথা জানিস, এই ধরনের লোকদের ওপর আমার বড় একটা দুর্বলতা আছে। আমি জানি, এমন কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে গবেষণা করতে গেলে মানুষ খুন করতে হয়। অথচ সেটা বেআইনী। সামান্য একটু বেআইনী কাজ করলে হয়তো পৃথিবীর মস্ত বড় উপকার হয়, তবু তা করা যাবে না। যারা বিজ্ঞান-পাগল, তারা কোনও আইন মানে না। প্রয়োজন মতো মানুষ খুন করা এদের কাছে অতি সাধারণ কাজ।

কামাল কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। শহীদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, তাই বলে মনে করিস না আমি এই মানুষ খুন আর টাকা চুরির ব্যাপারে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো। আমি এই পাগল বৈজ্ঞানিকের বিরুদ্ধে আমার সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো।



একটানা এতগুলো কথা বলে। শহীদ চুপ করলো। কামাল বললো, আমিও তাই বুঝি। যে করে হোক এই লোককে ধরিয়ে দিতেই হবে পুলিশের হাতে।

নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ ষ্টীমার চাঁদপুর ঘুরে যায়। বড়ো বেশি সময় লাগে তাতে। বেলা দুটোর সময় ষ্টীমারে উঠলে গোয়ালন্দ পৌছায় ভোর পাঁচটায়। সারাদিন হৈচৈ। টং টং করে নোঙর ফেলবার সময় শিকলের শব্দ। নানা রকম ফেরিওয়ালার ডাক। কলা, সন্দেশ, দৈ, রসগোল্লা, চানাচুর। অনেক রাতে স্টীমার একটু চুপ হয়। কেবল এঞ্জিনের একটানা শব্দ। মাঝে মাঝে কারো কোলের বাচ্চা কেঁদে ওঠে।

শহীদ আর কামাল সেকেন্ড ক্লাশ কেবিনে শুয়ে। বিকেলে স্টীমারের সামনের ডেকে চেয়ার পেতে বসেছিল ওরা। তাতে কামালের সর্দি করেছে। সে ঘুমোবার চেষ্টা করছে, আর শহীদ কি একটা মোটা ইংরেজি বই পড়ছে কম্বলটা দিয়ে পিঠ পর্যন্ত ঢেকে নিয়ে। এমন সময় কেবিনের দরজায় টোকা পড়লো। শহীদ দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, কিরে গফুর?

তোমরা কিছু খাবে, দাদামণি?

এতো রাতে আবার কি খাওয়াতে চাস? অবাক হয় শহীদ।

ককি বানিয়ে দেব?

কফি বানাবি মানে? কোথায় বানাবি? কি করে বানাবি?

গফুর গম্ভীর ভাবে বলে, সব কিছুই আমি সাথে করে এনেছি।

সাবাস গফুর, এতো গোলমালের মধ্যেও তোর ছোটোখাট কথা মনে থাকে!

প্রশংসায় কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে গফুর বললো, তোমার একলার জন্যে বানাবো, না কামাল ভাইও খাবে?



ওকে আর জাগাস না। বেচারার সর্দি লেগে গেছে। এখন একটু ঘুমোচ্ছে ঘুমিয়ে নিক।

এই কথা বলতেই পাশ ফিরে গফুরের দিকে চেয়ে একটা মনোরম হাসি দিয়ে কামাল আবার ঘুরে শুলো।

আর কোনো কথা না বলে গফুর নিজের কাজে লেগে গেল।

বছর কয়েক ধরে দাদামণির মাথায় যে কি ভূত চেপেছে, তাই নিয়ে গফুরের খুবই চিন্তা হয়। গম্ভীর ভাবে সে গত দুবছর ধরে দাদামণির কার্যকলাপ লক্ষ্য করে আসছে। তাতে চিন্তা তার বাড়ছে বই কমছে না। কিছুদিন যাবত সে শহীদকে চোখে চোখে রাখছে। গোয়ালন্দ যাবার কথা কিছুই শহীদ বলেনি গফুরকে। যেদিন রওনা হবে সেদিন গফুরকে একটু ব্যস্ত দেখা গেল। গোটা নয়েকের দিকে গম্ভীরভাবে শহীদকে বললো, ছোটো আপাকে কামাল ভাইদের বাড়ি রেখে এলাম।

আশ্চর্য হয়ে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, কেন রে।

ছোটো আপা তো একা বাড়িতে থাকতে পারবেন না!

আরও আশ্চর্য হয়ে যায় শহীদ। কেন, তাকে একলা থাকতে হবে কেন?

গম্ভীরভাবে গফুর ঘোষণা করলো, আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি। এই কথা বলে আর কোনও কথা উঠতে না দিয়ে সে সরে গেল সামনে থেকে। শহীদ হাঁ করে খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।



দুজনকে দুকাপ কফি দিয়ে গফুর চলে গেল। কামাল উঠে দরজা বন্ধ করে এলো। এমন সময় ঠক করে দরজায় একটা শব্দ হলো। দরজা আবার খুলতে যাচ্ছিলো কামাল। শহীদ লাফিয়ে উঠে ওকে ধরলো। তারপর বেশ জোরে ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলো, কে!

কোনও জবাব নেই। আবার টোকার শব্দ হলো। আরও জোরে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, কে?-এবারও কোনও জবাব নেই। কামাল একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। তাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে শহীদ প্রথমে নিঃশব্দে বন্টুটা খুললো, তারপর একটা কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে আরেকটা খুলে ফেললো। সাথে সাথেই ঘরের ভিতর কাঠের দেয়ালে খট করে আওয়াজ হলো। ছোট্ট একটা তীর বিঁধে আছে দেয়ালে। দরজাতেও দুটো একই রকমের তীর বিঁধে আছে। বাইরে চাইলো শহীদ। কেউ কোথাও নেই, কেবল সামনে কিছু দূরে স্টীমার-ক্যান্টিনে একটা বেঞ্চির উপর একজন লোক আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।

তীর দুটো খুলে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো শহীদ। ঘরের দেয়ালে যে তীরটা বিঁধে ছিলো সেটাও খুলে আনলো।

ছ ইঞ্চি লম্বা। পিছনে অনেকগুলো নরম পালক। পালকের কাছটাতে একটা ছোট্ট চিঠি। শহীদের ঘাড়ের পাশ দিয়ে ঝুকে পড়লো কামাল চিঠিটার উপর। তাতে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখাঃ

শহীদ খান,

তোমাকে আমি অনুরোধ করেছিলাম আমার কাজে বাধা দিয়ো না। তবু তুমি আমার পিছনে লেগেই রয়েছো। আমার শক্তি সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করবার জন্যে এটুকু করলাম। এ তীর চিঠি বয়ে নিয়ে গিয়ে তোমার বুকে একটু বিধেছে, যদি পটাশিয়াম সায়ানাইড বয়ে নিয়ে এটুকু বিধতো তবে কেমন হতো? আমার পক্ষে তা অসম্ভব নয়। অতএব, বন্ধু, ঘরে ফিরে যাও। নইলে পরে এমন বহু সুযোগই আমি পাবো যখন তোমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করবো না। তোমার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে এর বেশি বলা বাহুল্য মনে করছি। ইতি–

কুয়াশা

শহীদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো চিঠিটা পড়ে।

কামাল বললো, কী সাংঘাতিক লোক দেখেছিস।

দেখলাম। বন্ধু একটু ভুল করেছে। মনে করেছে তীর সোজা এসে আমার বুকে বিধেছে।

বিধতোই তো! আমি তো মনে করেছিলাম দরজায় টোকা পড়ছে, গফুর এসেছে বুঝি। তুই বুঝলি কি করে, এ টোকায় সন্দেহ করবার কিছু আছে?



টোকার আওয়াজ শুনলেই চেনা যায়। একটা টোকার ফলে দরজায় কখনও ঘরর শব্দ হয় না।

তুই বাইরে কাউকে দেখলি না?

একজন লোক বেঞ্চির উপর শুয়ে ছিলো কষল মুড়ি দিয়ে।

ও-ই বোধকরি তীর মেরেছে।

বোধকরি কেন, আমার স্থির বিশ্বাস ও-ই মেরেছে।

তাহলে তাড়া করে ধরলি না কেন? চল ব্যাটাকে ধরে পুলিশে দিই।

এখন কোনো লাভ নেই গিয়ে। দরজা খুলে দেখ কেউ নেই ওখানে।

কামাল দরজা খুলেই দেখলো সত্যিই কেউ নেই। শহীদ বললো, আমি দরজা খুলেই ওর কাছে ছুটে যেতে পারতাম। কিন্তু তাতে আহত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হতো না। ওদের আরও লোক নিশ্চয়ই ছিলো কাছাকাছি নল হাতে করে। আমরা এগোলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ঐ রকম ছোটে তীর এসে লাগতো।

নল হাতে থাকবে কেন?

এই তীরগুলো ধনুক থেকে ছোড়া হয়নি। বর্ষায় পাখি শিকারের জন্যে এই রকম তীর ব্যবহার করা হয়।

টেকনাফ অঞ্চলে মগদের মধ্যেও এর ব্যবহার আছে। সরু একটা নলের মধ্যে এই তীর ভরে অন্যদিকে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিতে হয়। অনায়াসে তিরিশ চল্লিশ হাত দূরে এই তীর ফেলা যায় ফুঁ দিয়ে। অভ্যেস হয়ে গেলে পঞ্চাশ ষাট গজ পর্যন্ত যায়। তীরের আগায় থামোফোনের পিনের মতো একটা চোখা লোহা থাকে, পিছনে থাকে পালক। তাতে করে খুব ভালো সই হয়।

অদ্ভুত পদ্ধতি তো। লোহাটার আগায় সামান্য একটু বিষ মাখিয়ে নিলেই একটা মানুষকে অনায়াসে সাবাড় করে দেয়া যায়। কোনো শব্দ নেই। বন্দুকের চেয়ে মারাত্বক!



ওসব চিন্তা এখন রাখ তো। কাল সারাদিন অনেক কাজ আছে, এখন একটু ঘুমিয়ে নে।



এই বলে দুই ঢোকে কফিটুকু শেষ করে শহীদ খাটের তলায় রেখে দিলো কাপটা। তারপর বিছানায় শুয়ে কল টেনে দিলো গলা পর্যন্ত। কামালও তার বিছানায় ঢুকলো। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কারো চোখে ঘুম এলো না।

Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: কুয়াশা - ০১
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ০৪. চার পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে
পরবর্তী :
Next post:০৬. গোয়ালন্দ থানার দারোগা »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *

COMMENT


NAME *


EMAIL *


WEBSITE




Search for:

0 Response to "কুয়াশা - ১ | পর্ব - ৫"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন