Ads Golpo.Best Kobita.Best

search

ময়ূরাক্ষী | পর্ব - ৩


আমার শৈশব যাদের সঙ্গে কেটেছে–তারা কেমন?
জন্মের সময় আমার মা মারা যান, কাজেই মার কথা কিছুই জানি না। তিনি দেখতে কেমন তাও জানি না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে তাঁর কোনো ছবি নেই। বাবা মারা যান আমার ন-বছর বয়সে। তাঁর কথাও তেমন মনে নেই। তাঁর কথা মনে পড়লেই একটা উদ্বিগ্ন মুখ মনে আসে। সেই মুখে বড় বড় দুটি চোখ। ভারী চশমায় ঢাকা বলে সেই চোখের ভাবও ঠিক বোঝা যায় না। মনে হয় পানির ভেতর থেকে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবার উদ্বিগ্ন গলা, কিরে তোর ব্যাপারটা কী বল তো? পেট ব্যথা করছে?
বাবার বোধহয় ধারণা ছিল শিশুদের একটি মাত্র সমস্যা–পেট ব্যথা। তারা যখন মন খারাপ করে বসে থাকে তখন বুঝতে হবে তার পেট ব্যথা করছে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে কোনো শিশু যদি জেগে উঠে কাঁদতে থাকে তখন বুঝতে হবে তার পেটে ব্যথা।
বাবার কাছ থেকে কত অসংখ্যবার যে শুনেছি–কী রে হিমু তোর কি পেট ব্যথা না কি? মুখটা এমন কালো কেন? কোন জায়গায় ব্যথা দেখি।
বাবা যে এক জন পাগল ধরণের মানুষ এটা বুঝতে আমার তেমন দেরি হয় নি। শিশুদের বোধশক্তি ভালো। পাগল না হলে নিজের ছেলের নাম কেউ হিমালয় রাখে?



স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলেন। হেডস্যার গম্ভীর গলায় বললেন, ছেলের নাম কী বললেন–হিমালয়?
জি।
আহমদ বা মোহাম্মদ এইসব কিছু আছে?
জি না, শুধুই হিমালয়।
হেডস্যার অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, ও আচ্ছা।
বাবা উৎসাহের সাথে বললেন, নদীর নামে মানুষের নাম হয়, ফুলের নামে হয়, গাছের নামে হয়, হিমালয়ের নামে নাম হতে দোষ কী?
হিমালয় নাম রাখার বিশেষ কোনো তাৎপর্য কী আছে?
অবশ্যই আছে–যাতে এই ছেলের হৃদয় হিমালয়ের মতো বড় হয় সেজন্যই এই নাম।
তাহলে আকাশ নাম রাখলেন না কেন? আকাশ তো আরো বড়।
বড় হলেও তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। হিমালয়কে স্পর্শ করা যায়।
কিছু মনে করবেন না। এই নামে স্কুলে ছেলে ভরতি করা যাবে না।
এমন কোনো আইন আছে যে হিমালয় নাম রাখলে সেই ছেলে স্কুলে ভরতি হতে পারবে না?
আইন টাইন আমি জানি না। এই ছেলকে আমি স্কুলে নেব না।
কেন?
সিট নেই?
আগে তো বললেন সিট আছে।
এখন নেই।
শিক্ষক হয়ে মিথ্যা কথা বলছেন–তাহলে তো এখানে কিছুতেই ছাত্র ভরতি করা উচিত না। মিথ্যা কথা বলা শিখবে।
খুব ভাল কথা। তাহলে এখন যান।
এই দীর্ঘ কথোপকথনের কিছুই আমার মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। বাবা প্রতিটি ঘটনা লিখে রেখে গেছেন বলে বলতে পারলাম। বাবার মধ্যে গবেষণাধর্মী একটা ব্যাপার ছিল। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে পাতার পর পাতা পরিষ্কার অক্ষরে লিখে গেছেন।
তাঁর বিদ্যা ছিল ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার পর রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন আর ফিরে যান নি।



জীবিকার জন্যে ঠিক কী কী করতেন তা পরিষ্কার নয়। জ্যোতিষবিদ্যা, সমুদ্রজ্ঞান, লক্ষণ বিচার এই জাতীয় বইয়ের স্তুপ দেখে মনে হয় মানুষের হাতটাত দেখতেন। একটা প্রেমের সঙ্গেও সম্ভবত যুক্ত ছিলেন। কয়েকটা নোটবই ও লিখেছিলেন। নোটস অব প্রবেশিকা সমাজবিদ্যা। এরকম একটা বই।
তাঁর পরিবারের কারোর সঙ্গে তাঁর কোনোই যোগাযোগ ছিল না। তাঁদের সম্পর্কে আমি জানতে পারি বাবার মৃত্যুর পর। গুরুতর অসুস্থ্য অবস্থায় বাবা তাঁর বড়বোনকে একটি চিঠি লিখে জানান যে তাঁর মৃত্যু হলে আমাকে যেন আমার মার বাড়ি পাঠানো হয়। এটাই তাঁর নির্দেশ। এর অন্যথা যেন না হয়।
চিঠি পাওয়ার পরপরই বাবার দিকের আত্মীয়স্বজনে আমাদের ছোট বাসা ভরতি হয়ে যায়। আমার দাদাজানকে তখনি প্রথম দেখি। সুঠাম স্বাস্থ্যের টকটকে গৌরবর্ণেও এক জন মানুষ। চেহারার কোথায় যেন জমিদার-জমিদার একটা ভাব আছে। তিনি মরণাপন্ন বাবার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমার ভূল হয়েছে। আমি বাবা তোর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে, আর না।



আমার বাবা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা যাক ক্ষমা করলাম। কিন্তু আমি চাই না আমার ছেলে আপনাদের সঙ্গে মানুষ হোক। ও যাবে তার মামাদের কাছে।
তার মামারা কি আমাদের চেয়ে ভালো?
না ওরা পিশাচ শ্রেণীর–ওদের সঙ্গে থাকলে অনেক কিছু শিখবে।
আমার দাদাজান এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললেন। বৃদ্ধ এক জন জমিদার ধরনের মানুষ কাঁদছে–এই দৃশ্যটি সত্যিই অদ্ভুদ। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুই এক পাগল, তোর ছেলেটাকেও তুই পাগল বানাতে চাস?
এই নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না।
আমাদের বড়লোক আত্মীয়স্বজনরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে আমাদের বাসার সাজসজ্জা দেখতে থাকেন। এর ফাঁকে ফাঁকে বাবার সঙ্গে আমার দাদাজানের কিছু কথাবার্তা হলো। যেমন–
ঢাকায় কতদিন ধরে আছিস?
প্রায় তিন বছর।
এর আগে কোথায় ছিলি?
তা দিয়ে আপনার দরকার কী?
তোর মা যখন অসুস্থ্য তখন সব খবরের কাগজে তোর ছবি ছাপিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম।
খবরের কাগজ আমি পড়ি না।
আমার বড়ফুপু এই পর্যায়ে হাত ইশারা করে আমাকে ডাকলেন। আদুরে গলায় বললেন, খোকা তোমার নাম কী?
আমি বললাম, হিমালয়।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন।
দাদা দুঃখিত গলায় বললেন, ছেলের নাম কি সত্যি সত্যি হিমালয় রেখেছিস?
হুঁ।
বাবার সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে তাঁকে একটা বড় ক্লিনিকে ভরতি করা হলো। আপত্তি করার মতো অবস্থাও তাঁর ছিল না। কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দুই একটা ছোটখাটো বাক্য বলতেও তাঁর কষ্ট হত। তাঁকে বাইরে চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হবে এমন কথা শোনা যেতে লাগল। বাবা তাঁদের সেই সুযোগ দিলেন না। ক্লিনিকে ভরতি হবার ন-দিনের দিন মারা গেলেন।
সজ্ঞানের মৃত্যু যাকে বলে। মৃত্যুও আগমুহূর্তেও টনটনে জ্ঞান ছিল। আমাকে বললেন, তোমার জন্য কিছু উপদেশ লিখে রেখে গেছি। সেগুলো মন দিয়ে পড়বে। তবে লেখাটা অসম্পূর্ণ। সম্পূর্ণ করবার সময় হলো না। আমার দিকের আত্নীয়স্বজনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখবে না এবং তাদের সাহায্য নেবে না। তবে ষোল বছর পরে তুমি যদি মনে কর আমার সিদ্ধান্ত ভুল, তখন তুমি নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এর আগ পর্যন্ত মামার সঙ্গে থাকবে। মনে রাখবে তোমার মামারা পিশাচ শ্রেণীর। পিশাচ শ্রেণীর মানুষদের সংস্পর্শে না এলে, মানুষের সৎগুণ সম্পর্কে ধারণা হবে না।



ডাক্তার এই পর্যায়ে বললেন, আপনি দয়া করে চুপ করুন। ঘুমুবার চেষ্টা করুন।
বাবা শীতল গলায় বললেন, প্রতিপদ শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ায় আমার মৃত্যু হবার কথা। কাজেই আমাকে বিরক্ত করবেন না। সবচে জরুরি কথাটাই আমার ছেলেকে বলা হয়নি–শোন হিমু, কোনো রকম উচ্চাশা রাখবি না। টাকা-পয়সা করতে হবে, বড় হতে হবে, এই সব নিয়ে মোটেও ভাববি না। সমস্ত কষ্টের মূলে আছে আমাদের উচ্চাশা। আমার উচ্চাশা ছিল বলে প্রথম দিকে খুবই কষ্ট পেয়েছি। শেষের দিকে উচ্চাশা ত্যাগ করতে পেরেছিলাম তাই খানিকটা আনন্দে ছিলাম। আনন্দে থাকাটাই বড় কথা। সবসময় আনন্দে থাকার চেষ্টা করবি।
বাবা কথা বলতে বলতেই একটু থামলেন, হঠাৎ গভীর আগ্রহ এবং বিস্ময়ের সঙ্গে চারদিকে তাকালেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, ও আচ্ছা তাহলে এর নামই মৃত্যু। এটা মন্দ কী? মৃত্যু তাহলে খুব ভয়াবহ নয়।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবার মৃত্যু হলো।
আমি কিছুদিন আমার দাদাজানের সঙ্গে থাকলাম। তিনি আমার প্রসঙ্গে বারবার বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগলেন।
আরে এটা কেমন ছেলে বাবা মরে গেল এক ফোঁটা চোখের পানি নেই। এ তো দেখি তার বাপের চেয়ে পাগল হয়েছে। এই দিকে আয়। বাপ-মা মারা গেলে চোখের পানি ফেলতে হয়।
আমি শীতল গলায় বললাম, আমাকে তুই-তুই করে বলবেন না।
তিনি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
দাদাজানের বাড়িটা বিশাল। সেই বিশাল বাড়ির দোতলায় একটা ঘর আমাকে দেয়া হলো। সেই ঘরে এই বাড়ির ছেলে-মেয়েদের জন্যে সার্বক্ষণিক প্রাইভেট টিউটর থাকেন। তাঁর নাম কিসমত মোল্লা।
তিনি যখন শুনলেন আমি কোনো স্কুলে পড়ি না, এতদিন বাবার কাছে পড়েছি তখন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন।
কী পড়েছ বাবার কাছে?
ইংরেজী, বাংলা, অঙ্ক, ভূগোল, আর নীতিশাস্ত্র।
নীতিশাস্ত্রটা কী?
কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এইসব।
কী বলছ কিছুই তো বুঝলাম না ।
যেমন ধরুন মিথ্যা। মিথ্যা বলা মন্দ। তবে আনন্দের জন্যে মিথ্যা বলায় অন্যায় নেই। মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে চিনতে পারি।
বলছ কী এসব! বুঝিয়ে বল।
যেমন ধরুন গল্প-উপন্যাস। এসব মিথ্যা। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে চিনতে পারি।
মাস্টার সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। নিজেকে অতি দ্রুত সামলে নিয়ে বললেন–অমবস্যা ইংরেজী কী জানো?



জানি। অমবস্যা হলো নিউমুন। বলে নিউমুন কিন্তু আকাশে তখন চাঁদ থাকে না।
মৃন্ময় শব্দের মানে কী?
মৃন্ময় হলো মাটির তৈরি।
মাস্টার সাহেব আমার কথাবার্তায় অত্যন্ত চমৎকৃত হলেন, কিন্তু বাড়ির অন্য কেউ হলো না । আমার দাদাজান ক্রমাগত বলতে লাগলেন–তোর বাবা ছিলেন পাগল। উন্মাদ। ও যে সব শিখিয়েছে সব ভুলে যা। সব নতুন করে শিখবি। তোকে ভালো ইংরেজি স্কুলে ভরতি করে দেব। আর শোন তোর নাম দিলাম চৌধুরী ইমতিয়াজ। মনে থাকবে?
দাদাজান বাড়িতে ঘোষণা করে দিলেন একে কেউ হিমালয় বা হিমু , কিছুই বলে ডাকতে পারবে না । এর নাম ইমতিয়াজ চৌধুরি। ডাক নাম টুটুল। মনে থাকবে? এই ছেলের মাথার ভিতর এই নাম দুটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। সারাদিন খুব কম করে হলেও একে পঁচিশবার চৌধুরি ইমতিয়াজ এবং পঁচিশবার টুটুল ডাকতে হবে, Its an order.
আমাকে সত্যি সত্যি একটা ইংরেজি স্কুলে ভরতি করে দেয়া হলো। স্কুলের পোশাক বানানো হলো।
প্রথমদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি ময়লা পায়জামা-পাঞ্জাবি উপর একটা কোট চড়িয়ে অত্যন্ত রুগৃণ এক লোক বসার ঘরে বসে আছে । তার হাতে চকচকে নতুন একটা ছাতা, মনে হচ্ছে আজই কেনা হয়েছে। ভদ্রলোকের মুখ ভরতি পান। এস্ট্রেতে সেই পানের পিক ফেলছেন। তাঁর বসে থাকার ভঙ্গি , পান খাওয়ার ভঙ্গি এবং পানের পিক ফেলার ভঙ্গিতে কোনো সংকোচ নেই। যেন এই বাড়ির সঙ্গে তাঁর খুব ভালো পরিচয়। যেন এটা তাঁর নিজেরই ঘর-বাড়ি।
আমি ঘরে ঢোকামাত্রই বললেন, বাবা হিমালয়। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমি তোমার বড়মামা। আমাকে সালাম কর।
দাদাজান গম্ভীর গলায় বললেন, আমি তো আপনাকে বলেছি তাকে নিতে পারবেন না। সে গ্রামে গিয়ে কী করবে? সে এখানেই থাকবে । পড়াশোনা করবে। তাকে স্কুল ভরতি করা হয়েছে।
আমার বড়মামা বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলেন। যেন এই রকম হাস্যকর কথা তিনি আগে কখনো শুনেন নি।
দেখেন তালুই সাহেব। ছেলের বাবা পাত্র মারফত এই অধিকার দিয়ে গেছে । এখন যদি আপনারা দিতে না চান, বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। কোর্টে ফায়সালা হবে, উপায় কী? যদিও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা কোনো কাজের কথা না।
দাদাজানের মুখে কোনো কথা এল না। বড়মামা এস্ট্রেতে আর একবার পানের পিক ফেলে বললেন, বাবার ইচ্ছামতোই কাজ হোক। খামখা আপত্তি করছেন কেন? ছেলের খরচাপাতির জন্যে মাসে মাসে টাকা দিবেন। তাহলেই তো হয়।
আপনি কী করেন?
তেমন কিছু না । সামান্য বিষয়সম্পত্তি আছে। টুকটাক ব্যবসা আছে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার ছিলাম। এইবার জিততে পারি নাই। সতের ভোটে ঠগ খেয়েছি । যদি অনুমতি দেন একটু বেয়াদবি করি?
কী বেয়াদবি?
একটা সিগারেট ধরাই। এমন নেশা হয়েছে না-খেলে দমটা বন্ধ হয়ে আসে।
বড়মামা অনুমতির অপেক্ষা না করেই সিগারেট ধরালেন।
দাদাজান বললেন, আপনি একে নিতে চাচ্ছেন কারণ আপনার ধারণা একে নিলে মাসে মাসে মোটা টাকা পাবেন। তাই না?
বড়মামা অত্যন্ত বিস্মত হওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, এই হাতের পাঁচ আঙুলের ভিতর দিয়া অনেক টাকা গেছে। অনেক টাকা আসছে । টাকা আমার কাছে কিছুই না। আসছি রক্তের টানে। রক্তের টান কঠিন জিনিস তালুই সাহেব। এই – যে বোন বিয়ে দিলাম তারপরে আর কোনো খোঁজ নাই। কী যে যন্ত্রণা । যাক হিমালয় বাবাকে দেখে মনটা শান্ত হয়েছে। তা বাবা , তোমার নাম কি সত্যি হিমালয়?



আমি কিছু বলার আগেই দাদাজান বললেন, না ওর নাম চৌধুরি ইমতিয়াজ। চৌধুরী আগে কী জন্যে? চৌধুরী থাকবে থাকবে পিছে। আগে ঘোড়া তারপর গাড়ি।
কী বলেন তালুই সাব?
দাদাজান কোনো উত্তর দিলেন না। তাঁর চোখে-মুখে ক্রোধ ও ঘৃণা। চা এবং কেক এনে কাজের ছেলে সামনে রাখল। বড় মামার মুখে পান। সেই অবস্থাতেই চায়ে চুমুক দিলেন। কেক হাতে নিলেন।
দাদাজান বললেন, আমার ছেলে আপনার বোনের খোজ পেল কী করে?
সেটা তালুই সাব, আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেই ভালো হত। আফসোস সে জীবিত নাই। আমরা আপনার ছেলেকে খুজে বের করি নাই। সে বন্ধুর সাথে আমাদের অঞ্চলে এসেছিল তারপরে কেমনে কেমনে হয়ে গেল। সত্যি কথ বলতে কী তালুই সাব, বিয়ের পর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। বোনের খোঁজ নাই। নানা লোকে নানা কথা বলে। কেউ বলে নামকাওয়ান্তে বিয়ে করে নিয়ে গেছে, পাচার করে দেবে। ইন্ডিয়া পাকিস্তান তারপর ধরেন মিডল ইস্ট। এইসব জায়গায় মেয়েকে ভাড়া খাটাবে।
বাচ্চা ছেলের সামনে এ রকম কুৎসিত কথা বলবেন না।
কুৎসিত কথা না। এগুলো সত্যি কথা। এই রকম পার্টি আছে।
সত্যিকথা সবসময় বলা যায় না।
আমার কাছে এটা পাবেন না তালুই সাব। সত্য কথা আমি বলবই। ভালো লাগুক আর না-লাগুক।
তাই নাকি?
জি। আর হিমালয় বাবাকে নিয়ে যাব। পরশু সকালে এসে নিয়ে যাবে। তৈরি থাকতে বলেন। মামলার তদবিরে এসেছি। দুটা দিন লাগবে।
এই ছেলেকে আমি আপনার সঙ্গে দেব না।
এসব বলবেন না তালুই সাব। আত্নীয়ের মধ্যে গন্ডগোল আমার পছন্দ হয় না। আইনের আশ্রয় নিলে আপনারও ক্ষতি আমারও ক্ষতি। আর্থিক ক্ষতি, মানসিক ক্ষতি। কোর্ট ফি এখন বাড়ায়ে করেছে তিনগুণ। গরিব মানুষ যে একটু মামলা-মোকদ্দমা করবে সে উপায় রাখে নাই। বাবা হিমালয়,তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও না?
চাই।
এইটা তো বাপের ব্যাটা। আজ তাহলে উঠি তালুই সাব। বেয়াদবি যদি কিছু করে থাকি মাফ করে দিবেন। আপনার পায়ে ধরি।
বড়মামা সত্যি সত্যি পা ধরতে এগিয়ে গেলেন। দাদাজান চমকে সরে দাড়ালেন।
দুই দিন পর আমি মামার সঙ্গে রওনা হলাম।
গন্তব্য ময়মনসিংহের হিরণপুর।
আমার বাবা অনেকবারই বলেছেন, আমার মামার পিশাচ শ্রেণীর । কাজেই তাঁদের সম্পর্কে আগে থেকেই একটা ধারণা মনের মধ্যে ছিল। আমি বড় মামা এবং অন্য দুই মামার আচার-আচরণের মোটেই অবাক হলাম না ।
মামার বাড়ি উপস্থিত হবার তৃতীয় দিনের একটা ঘটনার কথা বলি। এই ঘটনা থেকে মামাদের মানসিকতার একটা আঁচ পাওয়া যাবে।



বড় মামার বাড়িতে তিনটা বিড়াল ছিল। এরা খুবই উপদ্রব করত। বড়মামার নির্দেশে বিড়াল তিনটাকে ধরা হলো। তিনি বললেন,হাদিসে আছে বিড়াল উপদ্রব করলে আল্লাহর নামে এদের জবেহ করা যায় । তাতে দোষ হয় না। দেখি বড় ছুরিটা বার কর। এই কাজ তো আর কেউ করবে না, আমাকে করতে হবে। উপায় কী?
মামা নিজেই উঠানে তিনটা বিড়ালকে জবাই করলেন। এর মধ্যে একটা ছিল গর্ভবতী।
ঐ বাড়িতে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হয় নি। তিন মামা একসঙ্গে স্কুলঘরের মতো লম্বা একটি টিনের ঘরে থাকতেন। পুরো বাড়িতে ছেলেপুলের বিশাল দল। তাদের জগৎ ছিল ভিন্ন। একসঙ্গে পুকুরে ঝাঁপ দেয়া, একসঙ্গে সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসা, একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া। জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা, গোল্লাছুট খেলা। খাওয়াও হত একসঙ্গে। এক মামি ভাত দিয়ে যাচ্ছেন। আর এক মামি দিচ্ছেন এক হাতা করে তরকারি, দুই হাতা ডাল। চামচে যা উঠে আসে তাই। কেউ বলতে পারবে না আমাকে এটা দাও ওটা দাও। বললেই চামচের বাড়ি।
আমাদের মধ্যে মারামারি লেগেই ছিল।এ ওকে মারছে। সে তাকে মারছে। সেসব নিয়ে কোনো নালিশও হচ্ছে না। নালিশ দেয়ায় বিপদ আছে। এক জন নালিশ দিল – কার বিরুদ্ধে নালিশ, কী সমাচার ভালোমতো শোনাই হলো না। হাতের কাছে যে কয় জনকে পাওয়া গেল পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলা হলো। সত্যিকার অপরাধী হয়তো শাস্তিও পেল না।
আমি এই বিশাল দলের সঙ্গে অবলীলায় মিশে গেলাম। সীমাহীন স্বাধীনতা–যে স্বাধীনতা সচরাচর শিশুরা পায় না।
আমরা কী করছি না করছি বড়রা তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায়ত না।
একজনের হয়তো জ্বর হয়েছে। সে বিছানায় শুয়ে কুঁ কুঁ করছে। কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। নিতান্ত বাড়াবাড়ি না হলে ডাক্তার নেই। মাসে একবার নাপিত এসে সবকটা ছেলের মাথা প্রায় মুড়িয়ে দিয়ে ধান নিয়ে চলে যাচ্ছে। কাপড়-জামারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এ ওরটা পরছে। ও তারটা পরছে।
মামাদের বাড়ি থেকেই আমি মেট্রিক পাস করি। যে বছর মেট্রিক পাস করি, বড় মামা সে বছরই মারা যান। তাঁর শত্রুর অভাব ছিল না। বলতে গেলে গ্রামের সবাই ছিল তাঁর শত্রু।
এক অন্ধকার বৃষ্টির রাতে একজন কেউ মাছ মারবার কোঁচ দিয়ে বড়মামাকে গেঁথে ফেলে। বিশাল কোঁচ। মামার পেট এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে যায়। কোঁচের খানিকটা পিঠ ছেদা করে বের হয়ে থাকে। উঠানে চাটাই পেতে মামাকে শুইয়ে রাখা হয়। দৃশ্য দেখার জন্যে সারা গ্রামের লোক ভেঙ্গে পড়ে।
তাঁকে সদরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মহিষের গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো। মামা ঠান্ডা গলায় বললেন, এতক্ষণ বাঁচব না। তোমরা আমাকে থানায় নিয়ে যাও। মরার আগে আমি কারা এই কাজ করেছে বলে যেতে চাই।
মামা কাউকেই দেখেন নি তবু তিনি মৃত্যুর আগে আগে থানার ওসির কাছে চার জনের নাম বললেন। তিনি বললেন, তাঁর হাতে টর্চ ছিল। তিনি টর্চ ফেলে ফেলে এদের দেখেছেন।
ওসি সাহেব মামার দেয়া জবানবন্দি লিখতে লিখতে বললেন–ভাই সাহেব, এই কাজটা করবেন না, ডেথ বেড কনফেসন খুব শক্ত জিনিস। শুধুমাত্র এর উপরই কোর্ট রায় দিয়ে দেবে। নির্দোষ কিছু মানুষকে আপনি জড়াচ্ছেন। এদের ফাঁসি না হলেও যাবজ্জীবন হয়ে যাবে।
মামা বললেন, যা বলছি সবই সত্যি। কোরান মজিদ আনেন। আমি মজিদে হাত দিয়া বলি–।
ওসি সাহেব বললেন, তার দরকার হবে না। নিন এখানে সই করুন। এটা আপনার জবানবন্দি।
মামা সই করলেন। মারা গেলেন থানাতেই। মরবার আগে মেজোমামাকে কানে কানে বললেন, এক ধাক্কায় চার শত্রু শেষ। কাজটা মন্দ হয় না।
চার শত্রু শেষ করার গাঢ় আনন্দ নিয়ে মামা মারা গেলেন। তবে মৃত্যুর আগে মৌলানা ডাকিয়ে তওবা করলেন। তাঁকে খুবই আনন্দিত মনে হলো।
বড়মামি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন। তাকে ডেকে বললেন, তওবা করে ফেলেছি। এখন আর চিন্তা নাই। সব পাপ মাপ হয়ে গেল। সরাসরি বেহেশতে দাখিল হব। খামখা কান্দ কেন? তওবা সময়মতো করতে না পারলে অসুবিধা ছিল। আল্লাহ পাকের অসীম দয়া। সময় পাওয়া গেছে। কান্নাকাটি না করে আমার কানের কাছে দরুদ পড়। কোরান মজিদ পাঠ কর।
মামার মৃত্যুর পর আমি ঢাকায় চলে এলাম। নতুন জীবন শুরু হলো বড় ফুপুর সঙ্গে।

Facebook Twitter WhatsApp Email
Categories: ময়ূরাক্ষী (১৯৯০)
পূর্ববর্তী :
Previous post:« ময়ূরাক্ষী ২/৮
পরবর্তী :
Next post:ময়ূরাক্ষী ৪/৮ »
LEAVE A REPLY
Your email address will not be published. Required fields are marked *

COMMENT


NAME *


EMAIL *


WEBSITE




Search for:

0 Response to "ময়ূরাক্ষী | পর্ব - ৩"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন