মুল গল্পের নামঃ | দ্যা ব্যাড ইভিনিং | খালিদ হাসান |
মুল বইয়ের নামঃ | অজানা |
মূলসূত্রঃ | Facebook.com |
পর্ব - ১ | পর্ব - ২ | পর্ব - ৩ | পর্ব - ৪ | পর্ব - ৫ | এক পাতায় সম্পূর্ণ
--আমার কিন্ত ভীষণ ভয় করছে।
লিজার মুখে কথাটা শুনে বাইক থামিয়ে ফেললাম আমি।"ভয়" শব্দটা শুনতে খুব বিরক্তিকর লাগে।আর লিজা বার বার এইসব কথা বলছে আর আমার মেজাজটা খারাপ করে দিচ্ছে। বাইক হঠাৎ করে থামিয়ে দেয়ায় একটু অবাক হয়েছে লিজা। আবারও বলে উঠলো..
--কি হলো! থামালে কেন? নাকি পেট্রোল শেষ? এজন্যই লোকে বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়!
আমি রাগত স্বরে জবাব দিলাম..
--তোমার কি মনে হয়না তুমি একটু বেশি বেশি ভয় পাচ্ছো! আর পেট্রোল ভরপুর আছে। তুমি খামোখা ভয় করোনাতো।
--ভয় পাবোনা তো কি? আমি কখনোই আমার পরিবারের সাথে এমন দুঃসাহস দেখাইনি।
--তো আমি দেখিয়েছিলাম বুঝি?
--মাঝপথে থামলে কেন তাহলে? নাকি ডিসিশন বদলাবে?
--না।তার দরকার নেই। জায়গাটার দিকে তাকিয়ে দেখেছো একবার?
.
আমার প্রশ্নটা শুনে লিজা এবার একটু নড়েচড়ে বসলো।চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।আমি বললাম ..
--বাইক থেকে নেমে পড়ো।
লিজা চারদিকে তাকাতে তাকাতে বাইক থেকে নেমে গেলো।
--জায়গাটা তো অনেক সুন্দর।আগে থেকেই চিনিতে নাকি জায়গাটা?
--না চিনতাম না। অপরিচিত জায়গা তাই বাইক নিয়ে আর সামনে এগোতে চাচ্ছি না। কেননা একটু পরেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। অন্ধকারে পথ ভুলে যেতে পারি।
--এরকম জায়গায় কেন এলে তাহলে! তুমি সবসময় ভুল সিদ্ধান্ত নাও। একটা কাজও তুমি পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক করোনা।
--উপস্থিত বুদ্ধি সবচেয়ে ভালো উপায়।
--হয়েছে হয়েছে। এখন কি তুমি রাতটা এখানেই কাটাতে চাইছো?
.
লিজার মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে হ্যাঁ বলার সাহস হলোনা আমার।বাইক থেকে নেমে আমিও চারদিকে তাকাতে লাগলাম।মহাসড়ক থেকে হঠাৎ করে একটা চোরা রাস্তা দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম।এরপর জঙ্গলের ছোট রাস্তা দিয়ে এই পথে এসে গেলাম।রাস্তাও চিনিনা।আর উদ্দেশ্য জানা নেই।তবে নিশ্চয়ই দূরে কোথাও যেতে হবে আমাদের।বাড়ি থেকে পালানোর পর নিশ্চয়ই পরিবারের লোকজন আগে আশেপাশের কাছের পরিচিত জায়গাগুলোতেই খুঁজবে।তাই আমাদের দূরের অপরিচিত জায়গায় যেতে হবে।সেই উদ্দেশ্যেই ছুটে চলেছি দুজনে।দুজনের প্রেম অনেকদিনের। শত বাধাবিপত্তি ছিলো এই প্রেমকে ঘিরে।দুই পরিবারের কেউই মেনে নেবেনা আমাদের ভালোবাসা।পরিবার থেকে প্রেম মেনে না নিলে সচরাচর প্রেমিক যুগলেরা যে দুঃসাহসিক পথ অবলম্বন করে সেই থিওরি আমরাও এখন প্রয়োগ করছি।অতপর অনেকটা পথ পাড়ি দেয়ার পর এখন আমাদের একটু বিশ্রাম নেয়ার পালা।
.
এখন আমাদের পেছনে ঘন জঙ্গল।আশেপাশে বড় বড় গাছগুলো মাথা উচুঁ করে দাড়িয়ে আছে।এরকম জঙ্গলে বাঘ ভাল্লুকের ভয় নেই। তবে অন্ধকারে ভয়টা এমনিতেই এসে যায়।পেছনের জঙ্গল থেকে চোখ সরিয়ে লিজা সামনের রাস্তায় তাকালো।সামনে একটা খরস্রোতা ছোট খাল বয়ে চলেছে।নিশ্চয়ই পাহাড়ী কোনো ঝড়নার পানি এই খাল দিয়ে বয়ে চলে যায়।বর্ষা মৌসুম না হয়েও খাল পানিতে টইটম্বুর। তবে খাল পার হওয়ার জন্য খালের উপর সুন্দর একটা কালভার্ট দেখা যাচ্ছে।তার ওপাশে উচুঁ উচুঁ পর্বত গুলো দাড়িয়ে আছে।প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমির কোল ঘেঁষে সৌন্দর্য অবলোকন করছি আমরা।লিজা অবাক হয়ে বলে উঠলো ..
--এটাতো দেখি স্বপ্নপুরী।তুমি নিশ্চয়ই প্ল্যান করেই এখানে আমাকে এনেছো।জায়গাটা কল্পনার চেয়েও একটু বেশি সুন্দর।
আমার চোখের দিকে তাকালো লিজা। বললো..
--সত্যি করে বলো তো, এটা তোমার পূর্ব পরিকল্পনা ছিলোনা?
যদিও জায়গাটার ব্যপারে আমি একদমই অবগত নই তবুও লিজাকে ইমপ্রেস করার জন্য মিথ্যা ক্রেডিট নিয়ে একটা গর্বসূচক হাসি দিয়ে বললাম ..
--তোমার প্রেমিককে এখনো চিনতে পারলে না লিজা? আমি কতটা রোমান্টিক তুমি আজও বুঝলে না।
--হাহাহা। জানতাম জানটুস। কিন্ত জানোতো, এত কিছু মনে হয় সুখের হবেনা।আমার খুব ভয় করছে এখনো।টেনশনে মাথা ঘুরছে।
--পাগল মেয়ে, ওইসব ভুলে যাও এখন। মনে করো পৃথিবী তে এখন শুধু তুমি আর আমি আছি আর আছে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আমাদের এখন উপভোগ করার সময়। টেনশনে মাথা ঘুরাবার সময় নয়।
.
কথাটা বলেই দুজনে দুজনার হাত ধরে কালভার্ট টার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।কালভার্ট এর উপরে গিয়ে কংক্রিটের রেলিং এ হেলান দিলাম আমি।লিজা আমার হাত ধরে পাশে দাড়ালো।সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।সূর্য অস্ত যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।লিজা প্রশ্ন করলো..
--কি ঠিক করলে? এই নির্জন জায়গাতেই রাত কাটাবে নাকি?
--ভয় পাচ্ছো কেন? আমি সব পরিকল্পনা করে এসেছি।
--ভয় পাবোনা! এইসব নির্জন জায়গা দিনের বেলা সুন্দর লাগলেও রাতের বেলা ভয়ংকর হয়ে উঠবে না তার কি গেরান্টি আছে!
.
লিজার কথাটা শুনে আসলেই একটু চিন্তা হতে লাগলো। কথাটা ফেলে দেয়ার মতো নয়।বিশেষ করে সন্ধ্যা হতে হতেই খুব খারাপ পরিস্থিতির তৈরি হয়ে যাবে।কিভাবে কাটাবো রাতটা জানিনা।যদিও সময়টা খুব খারাপ যাবে।তবুও ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয়া উচিৎ এখন কয়টা বাজে।
.
ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে লিজার দিকে তাকিয়ে তাকে অভয় দেয়ার জন্যই বলে উঠলাম ..
--হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে আমরা সবকিছু সহজ করে নিতে পারি। কাঁধ থেকে ব্যাগটা এখনো নামাওনি কেন?
.
কথাটা বলে আমি লিজার কাঁধ থেকে ব্যাগ টা ছাড়াতে লাগলাম। ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার। আর কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছি। পকেট থেকে লাইটারটা বের করতেই লিজা অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলো..
--খালিদ, তুমি কি সিগারেট খাও? সত্যি করে বলো।
--না রে বাবা, আগুন জ্বালাতে হবে তাই নিয়ে এসেছি। মেয়েরা যে কেন এমন সন্দেহপ্রবণ হয়! লাইটার কাছে থাকলেই কি কেউ স্মোকার হয়! ছুড়ি সাথে থাকলেই কি কেউ খুনি হয় নাকি! হতে পারে সে কসাই। নাকি রাইফেল সাথে থাকলেই কেউ সন্ত্রাসী হয়! হতে পারে সে সেনাবাহিনীর সদস্য।কলম সাথে থাকলেই কি কেউ পরীক্ষার্থী হয়! হতে পারে সে কবি।
--হয়েছে হয়েছে। আর প্যাঁচাতে হবেনা। তুমি একদম ভালো ছেলে। এবার খুশি?
--হ্যাঁ খুব। এই খুশিতে আসো মিষ্টি মুখ করি।
--একি! তুমি ব্যাগে মিষ্টিও এনেছো নাকি!
--আরে না রে পাগলী। এই মিষ্টি সেই মিষ্টি না। কাছে আসো বুঝাচ্ছি।
কথাটা শেষ করে লিজার হাতটা ধরে এক ঝটকায় কাছে নিয়ে এলাম।কোমড় জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মেশাতে যাবো এমন সময় চমকে উঠলাম দুজনে।লিজার ফোনটা আচমকা বেজে উঠেছে।
.
পার্স থেকে ফোনটা বের করতেই লিজার হাত দুটো থর থর করে কাঁপতে লাগলো।ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো ..
--বাবা ফোন করেছে। কি করবো?
--পাগলী মেয়ে কোথাকার তুমি ফোনটা এখনো সুইচ অফ করোনি কেন!
ফোনটা থেমে গেলো তখনই।কয়েক সেকেন্ড পর আবারও রিংটোন বাজতে লাগলো। লিজা এবার আরো অবাক হয়ে বলে উঠলো..
--শিহাব। শিহাব ফোন করেছে।
শিহাবের নামটা শুনেই মেজাজ অত্যধিক বিগড়ে গেলো আমার। ফোনটা লিজার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে খালের পানিতে ছুড়ে মারলাম আমি।
.
--একি আমার নতুন ফোন টা ..
--বেচেঁ থাকলে আবার নতুন ফোন কেনা যাবে। পাগলী মেয়ে ফোন অন করে রেখেছিলে কেন! যদি আমাদের নাম্বার ট্র্যাক করে তাহলে ধরা পড়তে বেশি সময় লাগবে না। আর শিহাব নিশ্চয়ই জেনে গেছে আমাদের পালানোর ব্যপারে। শয়তানটা নিশ্চয়ই জেনে গেছে। আল্লাহ আল্লাহ করো যেনো আমাদের ট্র্যাক না করে।
আমার কথা শেষ হতেই লিজা বলে উঠলো..
--তুমি জানো, শিহাব আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। দুইবার প্রোপোজ ও করেছে আমাকে। ও আসলে কি চায়?
--ও তোমাকে ভালোবাসেনা লিজা।ও এসব করছে আমার সাথে শত্রুতা করে। কলেজ লাইফ থেকেই আমাদের শত্রুতা চলছে। আমার সব কিছুতে ও ঠ্যাং ঢুকিয়ে দিতে চায়।
--এমনও তো হতে পারে ও আমাদের ফলো করছে।
--আরে না। এত ভয় পাচ্ছো কেন? ওসব করবে না ও। আমরা যে পালিয়ে যাবো এটাতো আমরা নিজেরাই জানতাম না। শিহাব কি করে জানবে!
.
আমার কথাটা শেষ না হতেই লিজা চমকে উঠলো।একদম থ হয়ে দাড়িয়ে কালভার্ট টার প্রান্তে তাকিয়ে রইলো।আমিও সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।জিজ্ঞেস করলাম ..
--কি হলো লিজা!
লিজা কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলো..
--আমার মনে হলো গাছের আড়ালে কেউ লুকিয়ে আছে। সে আমাদের ফলো করছিলো। আমাদের দেখেই লুকিয়ে পড়েছে।
আমি লিজার কথা শুনে অট্টহাসি দিয়ে উঠলাম।ছেড়ে আসা কালভার্ট এর প্রান্তে একটা বড় গাছ খেয়াল করলাম।আসলেই গাছের পেছনে লুকিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। কিন্ত এই নির্জন জায়গায় আমাদের সাথে কে কেনই বা লুকোচুরি খেলবে! আমাদের খোঁজে কেউ আসলে নিশ্চয়ই সরাসরি ধরতে না এসে লুকোচুরি খেলবে না। হো হো করে হেসে নিয়ে বললাম ..
--ওরে পাগলী মেয়ে তুমি এত ভীতু কেন? শিহাব বা অন্যকেউ কেন এখানে আসবে এত তাড়াতাড়ি! তুমি অতিরিক্ত ভয়ের কারণে হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়েছো। তাছাড়া এখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। তাই হয়তো ভুল দেখেছো পাগলী মেয়ে কোথাকার।
কিন্ত আমার কথা মানতে পারলো না লিজা। জোর গলায় বললো ..
--না, আমি স্পষ্ট দেখেছি কেউ একজন লুকিয়েছে গাছের আড়ালে।
লিজাকে শান্ত করার জন্য বললাম ..
--আচ্ছা তাহলে চলো সত্য উদ্ঘাটন করা যাক। গিয়েই দেখা যাক গাছের আড়ালে কে!
.
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে লিজার হাত ধরে যেতে লাগলাম গাছটার দিকে।ভয় আমারও একটু একটু করছে।যদি শিহাব আমাকে ফলো করে থাকে তাহলে খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে কপালে। লিজাকে যতই মিথ্যা শান্তনা দেইনা কেন শিহাবের মতো পাক্কা হারামীর ব্যপারে আমি নিজেও আন্দাজ করতে পারিনা। নিজের স্বার্থের জন্য আর আমাকে বিপদে ফেলার জন্য সে সবকিছু করতে পারে।শিহাব আর আমি কলেজ লাইফের বন্ধু ছিলাম।কিন্ত মাঝখানে ওর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঝামেলা হয়। আমরা দুজনই একই রকম দেখতে।কেউ কেউ বলতো আমাদের ভয়েস ও নাকি একই রকম। দুজনকে উলোট পালোট করে দিলে কেউ কিছু টের পাবেনা।যদিও ব্যপারটা তা নয়।আমাদের চেহারায় অনেক অমিল রয়েছে।কিন্ত ওর স্বার্থপর গার্লফ্রেন্ড একদিন আমাকে প্রপোজ করে দিলো। কারণ সেবছর লেখাপড়াতে আমি শিহাবের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলাম।কিন্ত ব্যপারটা কোনোরকমে জেনে যায় শিহাব। ওর গার্লফ্রেন্ডের পরে কি হয়েছে জানিনা তবে শিহাব আমার সাথে শত্রুতা শুরু করে দেয়। শিহাবকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি অনেক কিন্ত কিছুই বুঝতে চায়না।তাই শত্রুতার জবাব আমিও শত্রুতার মাধ্যমে দেয়া শুরু করলাম। একটা মেয়ে শুধু শুধু আমাদের মধ্যে শত্রুতা বানালো।হিংসা থেকে উৎপন্ন হওয়া এখন সেই শত্রুতা ঘোর হয়ে গেছে। মানুষ বড় হয়, বড় হয়ে যায় তাদের মগজের বুদ্ধি। তাই শত্রুতাগুলো এখন অনেক উচ্চ পর্যায়ের।তবে আমাকে এখনো বড় কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি শিহাবের জন্য। আসলে শিহাবের শত্রুতা আগে থেকেই বুঝতে পেরে আমিও পাশ কাটাই। এখন আমার প্রেমিকাকে নিয়ে পড়েছে। কিছুতেই নাকি আমাদের এক হতে দেবেনা। ঠিক আছে দেখা যাবে।
.
গাছের কাছাকাছি গিয়ে দুজনেই গাছের পেছনে উপড়ে নিচে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না।আশেপাশে তাকালাম আমি। না কোনো জনমানবের অস্তিত্ব নেই।লিজাকে উদ্দেশ্যে করে বললাম ..
--পাগলী মেয়ে, বলেছিলাম না খামোখা ভয় পাচ্ছিলে। তুমি আসলে সেই শুরু থেকেই ভয় পাচ্ছো। অতিরিক্ত ভয়ের কারণে এমন উল্টাপাল্টা দেখছো।এত ভয় নিয়ে কি প্রেম করা যায়!
লিজা মাথা নিচু করে কোমল কন্ঠে বললো..
--সত্যিই তো! কেউ ফলো করছে না তো!
--না রে বাবা। এত ভয় পেওনা। আমি আছিতো।
আমার কথাটা শেষ করতে পারলাম না। কেমন একটা পঁচা গন্ধ নাকে আসলো। গন্ধে দুজনে নাক চেপে ধরলাম। লিজা বলে উঠলো..
--কেমন পঁচা একটা গন্ধ আসছে।
আমি তাকিয়ে দেখলাম কিছুদূরে অনেক ঝোপঝাড় খালের পাশ ঘেঁষে। সেখান থেকেই সম্ভবত এমন কটু গন্ধ আসছে। লিজাকে বললাম ..
--মনে হচ্ছে কোনো সাপ মরে পঁচে গেছে ঝোপঝাড়ের ভিতরে। চলো আমরা কালভার্ট টার ওখানে যাই। ওখানে কোনো গন্ধ নেই।
.
আবারও হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম দুজনে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।অন্ধকার নেমে এসেছে।ব্যাগ থেকে খাবার বের করে দুজনে খেয়ে নিলাম। লিজা বললো..
--ঘুমাবো কোথায়? পরবর্তী কোনো পরিকল্পনা আছে কি তোমার?
--চিন্তা কেন করছো এত! মে হু না ইয়ার।আমার ব্যাগে তাবু টাঙ্গানোর জন্য অনেক কিছুই আছে।তাবু টাঙ্গিয়ে ঘুমাবো। আর প্লিজ মশার কামড়টা একটু সহ্য করিও কেননা এর কোনো ব্যবস্থা আমি করতে পারিনি।আর কালকের পরিকল্পনা কালকে সকালে করা যাবে।বাই দ্যা ওয়ে তুমি এমন জায়গায় ঘুমাতে পারবে?
--মানে!
--মানে এমন রোম্যান্টিক পরিবেশে কিভাবে ঘুমাবে? আমার তো ইচ্ছে করছে সারারাত আজ প্রেম করে কাটিয়ে দিবো।
--হয়েছে, এত উতলা হতে হবেনা। সারারাত মশা মারতেই চলে যাবে। বলেছিলাম না সুন্দর জায়গাটা রাতের বেলা ভয়ংকর হয়ে যাবে।
--আমি ভালোবাসা দিয়ে মশার কামড় ভুলিয়ে দিবো চিন্তা করোনা।
--সবসময় আহ্লাদি তাইনা!
লিজার কথায় চুপ করলাম আমি।এমন অপরিচিত নির্জন পরিবেশে নিজের মনের মানুষের সাথে কাছাকাছি দাড়ালে একটা ছেলের কেমন অনুভূতি হয় তা কোনো মেয়ে আদৌ বুঝতে পারে কিনা জানিনা।রেলিং ধরে নিচে তাকিয়ে রইলাম দুজনে। জলের স্রোত দেখছি আর সময় পার করছি।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম রাত আটটা বেজে গেছে।খালের পার ঘেঁষে কিছু কংক্রিটের ব্লক সারিবদ্ধভাবে রেখে দেয়া। দুইপারেই প্রায় একই রকম। এটা সরকারি জায়গা নাকি ব্যক্তিগত জায়গা জানিনা। তবে জায়গাটা নিশ্চয়ই কোনো শৌখিন ব্যক্তির অধীনে আছে। আর জঙ্গলের পাহাড় ঘেরা একটা জায়গাতে এসব কাজ কে করলো সেটাও বুঝে আসেনি এখনো।কাল জায়গাটার ব্যপারে খোঁজ নিতে হবে।
.
মাথা ঘুড়িয়ে দূরে তাকালো লিজা। বলে উঠলো..
--আলোটা দেখতে পাচ্ছো খালিদ?
লিজার প্রশ্ন শুনে আমিও তাকালাম সেদিকে।খালের পার ঘেঁষে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেটা ওইপারে।অথচ দিনের বেলায় বাড়িটা দেখিনি আমরা। বললাম ..
--হ্যাঁ। আলোটা কোনো বাড়ি থেকে আসছে।
--দিনের বেলায় তো দেখিনি সেটা।
--আরে ঝোপঝাড় ঘেরা জঙ্গল এলাকা। এতকিছু কি নজরে আসে। এখন অন্ধকারে আলো জ্বলছে বলে দেখতে পাচ্ছি। তাছাড়া তুমি এত ভয়ের মধ্যে ছিলে এতকিছু খেয়াল করার সময় কি পেয়েছি আমরা!
--হ্যাঁ। তা ঠিক। বাড়ি যখন পেলাম তখন যাও বাইকটা নিয়ে আসো। আমরা বরং বড়িটাতে গিয়েই রাত কাটাই।
--আরে কি বলো! ওটা কি তোমার পরিচিত আত্মীয়র বাড়ি নাকি!
--আরে বিপদে পড়েছি জানালে নিশ্চয়ই থাকার ব্যবস্থা করবে।
আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম ..
--কথাটা অবশ্য ফেলে দেয়ার মতো নয়।কিন্ত আমি চাচ্ছি কিছুক্ষণ নির্জনে তুমি আমি একসাথে কাটাই।
--ততক্ষণে বাড়ির লোকগুলো ঘুমিয়ে যেতে পারে।
--আরে আমার তো মনে হয় ওরা অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে। আমরা বরং মাঝরাতেই যাবো।
--মাঝরাতে কেন!
--ততক্ষণ আমি আমার পাগলীটার সাথে প্রেম করবো।
--ধুর। আবার আহ্লাদি করছো ..
লিজা লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলো।আমি তাকিয়ে রইলাম লিজার চোখের দিকে। কিন্ত লিজা আমার দিকে না তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি হাসি ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলো খালের মাঝখানে।আমি সুযোগ বুঝে লিজার গা ঘেঁষে দাড়িয়ে হাতটা ধরে নিলাম আলতো করে।লিজা কি ভেবে যেনো চমকে উঠলো।তা লক্ষ্য করে আমি বললাম ..
--কি হলো! ভয় পেলে নাকি!
--খালিদ,মনে হলো খালের মাঝখানে এইমাত্র আমি একটা আলো জ্বলতে দেখলাম। যেটা জ্বলে উঠার সাথে সাথেই নিভে গেলো।
লিজার কথা শুনে মেজাজটা খারাপ করেই বলে উঠলাম ..
--এখনো ভয়ে উল্টাপাল্টা দেখছো! তুমি চোখ বন্ধ করোতো। আমার বিশ্বাস তুমি চোখ বন্ধ করলেও অনেক কিছু দেখবে। আসলে তুমি কিছুই দেখছো না নিজের চোখে, তোমার মস্তিষ্ক এইসব উল্টাপাল্টা জিনিস দেখাচ্ছে।
--না খালিদ, বিশ্বাস করো আমার মনে হচ্ছে আমি ঠিক দেখেছি ..
.
লিজার কথা শেষ করতে না দিয়ে রেলিং এ ওর হাতদুটো চেপে ধরলাম।ওর মুখোমুখি দাঁড়াতেই বলে উঠলো ..
--কি করছো খালিদ ..
--কোনো কথা নয় ..
লিজার ঠোঁটে আমার ঠোঁট মিশিয়ে দিলাম। লিজা সজোরে জাপটে ধরলো আমাকে। আমিও লিজাকে জাপটে ধরে ভালোবাসার বিনিময় করতে লাগলাম।ভালোবাসা বিনিময়ের জন্য এমন নির্জন পরিবেশ কখনো পাইনি এর আগে।আর লিজার অবান্তর ভয় গুলো দূর করার জন্য এই পদ্ধতি টা নিশ্চয়ই ভালো কাজ করবে। তাই মন ভরে ভালোবাসার বিনিময় করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম দুজনে।
.
ঠিক সেই মুহুর্তে পিঠে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলাম আমি। ব্যথায় কুকিয়ে উঠলাম।কেউ একজন পিঠে চাকু ঢুকিয়ে দিয়েছে।আমি কুকিয়ে উঠতেই লিজা আমাকে ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো।পেছন থেকে ছুড়িটা বের করে নিলো কেউ একজন। আমি ঘুরে তাকাতেই সে আমার শার্টের কলার চেপে ধরলো এক হাতে।আমিও হাত চালাতে লাগলাম কিন্ত পিঠে এত ব্যথা হচ্ছে যে শক্তি পেলামনা লোকটার সাথে লড়াই করার। লিজা ভয়ে চিৎকার করছে কিন্ত গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছেনা ততটা।প্রচন্ড ভয় পেলে এমনই হয়। কন্ঠস্বর ও চুপসে যায়। আমি আমার সামনে দেখতে পেলাম মুখ ঢাকা একটা লোককে। রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়া। হাতের ছুড়িটা আমার দিকে তুলে বললো..
--তোমাকে মরতে হবে খালিদ।এই চমৎকার সন্ধ্যা তোমার জন্য নয়, এটা আমার জন্য। গুড ইভিনিং খালিদ।গুড ইভিনিং ফর মি।ব্যাড ইভিনিং ফর ইউ।
.
কথাটা বলেই আমার বুকে ছুরি চালাতে যাবে এমন সময় লিজা লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। লোকটা ধাক্কা খেয়ে আমাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হলো। কিন্ত তাল সামলে নিয়ে লিজাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো।
আমার শার্ট রক্তে ভিজে গেছে। লোকটা আমার মুখেও ছুড়ি চালিয়ে দিলো। মুখের বিভিন্ন জায়গায় ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে গেলো। এরপর আমাকে রেলিং এর উপরে বসিয়ে দিলো।আমি শরীরে আর শক্তি পাচ্ছিনা ব্যথায়।
.
আমার হাটুতে ছুরির আঘাত করতে যাবে এমন সময় লিজা এসে আবারও ধরে ফেললো লোকটাকে। লোকটাকে লিজা পেছন থেকে জাপটে ধরায় আমাকে সে আর আঘাত করতে পারছে না। আমি চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। লোকটা লিজার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে লিজাকে জাপটে ধরে কিছু একটা বলতে লাগলো।শুনতে পেলাম না আমি। রেলিং থেকে নিচে পড়ে গেলাম।পানিতে পড়ার সময় বন্দুকের গুলির শব্দ শুনতে পেলাম।ঠাস করে একটা শব্দ হলো। মনে হলো বাজ পড়লো। তখনই আমিও পতিত হলাম খালের পানিতে। ভেসে যেতে লাগলো আমার অর্ধমৃত দেহটা।লিজার কি হাল হলো জানিনা। নিশ্চয়ই সেটা শিহাব ছিলো। আমাকে মারার পর এখন নিশ্চয়ই লিজাকেও শেষ করে দিবে শয়তানটা।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো আমার।বাঁচাতে পারলাম না নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না নিজের ভালোবাসাকে।পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে চলেছি ভেসে। সাঁতার কাটারও শক্তি পাচ্ছিনা। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি।
.
.
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে দেখলাম পারঘেষে একটা কলাগাছের সাথে আমার শরীর আটকে আছে।আসলে কলাগাছ বললে ভুল হবে। এটা একটা কলাগাছের তৈরি ভেলা। হামাগুড়ি দিয়ে পারে উঠে গেলাম। পিঠে এখনো ব্যথা করছে। মুখেও ব্যথা করছে। পারে উঠতেই খেয়াল করলাম আমি সেই বাড়িটার সামনে দাড়িয়ে আছি। কালভার্ট থেকে লিজা আর আমি এই বাড়িটাই দেখেছিলাম। একতলা বিশিষ্ট ভবন। তবে বারান্দার আলোটা কালভার্ট থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেটে বাড়িটার গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। শরীরে একদম শক্তি নেই আর। কলিং বেলের সুইচ টা দেখে একবার চাপ দিলাম। চাপ দিতেই শক্তি হারিয়ে ধুপ করে নিচে পড়ে গেলাম আবার। আবারও চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তবে কানে শুনতে পেলাম কেউ একজন দরজা খুলছে।নিশ্চয়ই দরজার সামনে অর্ধমৃত এক আগন্তুক দেখে অনেক অবাক হবে সে।
পর্ব - ১ | পর্ব - ২ | পর্ব - ৩ | পর্ব - ৪ | পর্ব - ৫ | এক পাতায় সম্পূর্ণ
0 Response to "দ্যা ব্যাড ইভিনিং | খালিদ হাসান | পর্ব - ১"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন